সন্ত্রাস দমনে নয়া অভিমুখ খুঁজছে দিশাহারা আমেরিকা

ডিসেম্বর ৮, ২০১৫
10ওয়াশিংটন: সন্ত্রাসদমন নীতির অভিমুখ ফেরাতে হবে নিজের ঘরের দিকেই, কার্যত স্বীকার করে নিল মার্কিন প্রশাসন৷ ক্যালিফোর্নিয়া হামলার প্রেক্ষিতে শনিবার তার সাপ্তাহিক রেডিও ও ইন্টারনেট ভাষণে আইএস-এর তরফে নিজেদের দেশের ভিতরে থেকেই একক চেষ্টায় সন্ত্রাস হামলা চালানোর যে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ইসলামিক স্টেট-কে (আইএস) ধ্বংসের ডাক দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। মার্কিন সময় রোববার রাতে টেলিভিশনে ১৩ মিনিটের ভাষণে এ কথা বলেন ওবামা। উপলক্ষ ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নির্দিনোর ‘মৌলবাদী’ দম্পতির হাতে ১৪ জনের মৃত্যু।

কিন্তু কী ভাবে আইএস দমনের লক্ষ্যপূরণ করবেন ওবামা। তার পরিকল্পনা কী? তিনি জানালেন, প্রথমত, পদাতিক সেনা নয়, বিমানহানা বাড়ানো আর স্পেশ্যাল ট্রুপ পাঠানো হবে। দ্বিতীয়ত, আইএস-এর অর্থ রোজগারের পথ বন্ধ করা হবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় আইএস বিরোধী সেনাদের প্রশিক্ষণ এবং অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করা।

কিন্তু ওবামার এই পরিকল্পনাটি আদৌ নতুন নয়। প্রায় এক বছর ধরে আদতে এই পথেই আইএস দমনে রত আমেরিকা। আর এই নীতি নিয়ে সমালোচনায় মুখর বিরোধী রিপাবলিকানরা। রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা তো আসরে নেমেই পড়েছেন। এমনকী, এই ভাষণের পরে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সমীক্ষা বলছে, এই পরিকল্পনা মার্কিন জনগণের বড় অংশের না-পসন্দ।

মার্কিন জনগণের পছন্দের উপরে আইএস দমন নীতি নির্ভর করে না। নির্ভর করাও উচিত নয়। কিন্তু ওবামার এই নীতির কার্যকারিতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন তোলাই যায়। কারণ, সিরিয়া, ইরাক জুড়ে আইএস-এর মার্কিন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স— মহাশক্তিধররা হামলা বহুগুণ বাড়িয়েছে। সে হামলায় আইএস-এর পরিকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। সঙ্গে আছে স্পেশ্যাল ট্রুপের হানা, আইএস বিরোধীদের অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য, ইরাকি এবং কুর্দ সেনাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্য।

কিন্ত্ত প্রেসিডেন্ট যে ব্যবস্থার কথাই বলুন, ক্যালিফোর্নিয়া হামলা যে অন্তবর্তী নিরাপত্তা বিভাগের সামনে চূড়ান্ত জটিল একটা সমস্যা তুলে ধরেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ওয়াকিবহাল মহলের৷ এখনও পর্যন্ত প্রশাসনের তরফে যা যা ইঙ্গিত এসেছে তাতে স্পষ্ট, ক্যালিফোর্নিয়া হামলা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগাম ধারণা ছিল না রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির৷ তা সত্ত্বেও বুধবার ১৪ জন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ গিয়েছে এমন এক পূর্ব পরিকল্পিত সন্ত্রাসবাদী হামলায় যাকে ৯/১১-র পরে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসহানা বলে মানছেন বিশেষজ্ঞরাই৷ ক্যালিফোর্নিয়া হামলা একটা নতুন ট্রেন্ডকে সবার সামনে তুলে ধরেছে৷ নিজে থেকে জিহাদি মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে, দেশের বাইরে থেকে কোনও সাহায্য ছাড়াই, নিজের চারপাশের ‘সফ্ট টার্গেট’ বা সাধারণ মানুষের মতো দুর্বল নিশানার উপর মারণ আঘাত হানা৷ আমেরিকার মতো বড় দেশে এ ধরনের হামলা থেকে সাধারণ নাগরিকদের বাঁচানো রাষ্ট্রের পক্ষে অন্তত এই মুহূর্তে যে অসম্ভব, তা খুবই স্পষ্ট৷ শনিবার দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রী জেহ জনসন একটি সাক্ষাত্কাপরে তুলে ধরেছেন এই আশঙ্কার কথাই৷ তার বক্তব্য, ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একট সম্পূর্ণ নতুন পর্যায় শুরু হয়ে গিয়েছে৷ সন্ত্রাসবাদীরা সন্ত্রাস ছড়ানোর কাজটা কার্যত আমাদের দেশের ভিতরেই আউটসোর্স করে দিয়েছে৷ এটা মোকাবিলার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ভাবে ভাবতে হবে আমাদের৷’

দেখা যাচ্ছে, ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে সন্ত্রাসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য যা যা ব্যবস্থা নিয়েছিল মার্কিন সরকার – যেমন বিমান বন্দরে নিরাপত্তা কড়া করা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির উপর নজরদারি বাড়ানো – তার কোনওটিই ক্যালিফোর্নিয়া হামলার ক্ষেত্রে তাদের কাজে আসেনি৷ এখানে হামলাকারী এমন এক দম্পতি যারা আপাতদৃষ্টিতে একেবারে ছাপোষা, আইন মেনে চলা আদর্শ মার্কিন নাগরিক৷ সৈয়দ রিজওয়ান ফারুক ও তশফিন মালিকের ছোট, সুখী পরিবারটিকে সন্দেহের তালিকায় রাখার কথা কেউ ভাববেও না৷ ভালো মাইনের চাকরি, নিজস্ব বাড়ি, কর্মক্ষেত্রে উন্নতির আশ্বাস, এবং সর্বোপরি ৬ মাস বয়সের এক শিশুকন্যা – জিহাদি সন্ত্রাসবাদী বললে যে চেহারাটা ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে কোনো মিলই নেই৷ অথচ হামলার আগে আগ্নেয়াস্ত্র কেনা, সেগুলিতে পরিবর্তন এনে আরও বেশি প্রাণঘাতী করে তোলা, এবং বাড়ির চিলেকোঠাকে বোমা তৈরির কারখানা বানিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া কিন্ত্ত চলেছিল কয়েক মাস ধরেই৷

প্রত্যাশিত ভাবেই মার্কিন রাজনৈতিক মহলে এর প্রভাব পড়েছে বড়সড় ভাবেই৷ ২০১৬ প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের উত্তেজনার শুরু হতে আর দু’মাস বাকি৷ বিরোধী রিপাবলিকানরা দীর্ঘ দিন ধরেই ওবামার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন নিয়ে ‘নরমপন্থী’ মতবাদ পোষণের অভিযোগ তুলছেন৷ একই পথে না হলেও, এবার কিন্ত্ত সমালোচনাটা ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক মহলের বাইরেও৷

রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাক্তন মার্কিন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আধিকারিক জন ডি কেহেন যেমন এ দিন স্পষ্টই বলেছেন, ‘প্রশাসনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এ ধরনের হামলা ঠেকানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়৷’ প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র দপ্তর প্রধান আলবের্তো এম ফার্নান্ডেজ হামলার এই ধরনকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘ডিওয়াইআই জিহাদ’ অর্থাত্ ‘নিজে হাতে করো জিহাদ’, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে চরমপন্থী আদর্শ ছড়িয়ে যাচ্ছে আমেরিকার একেবারে ঘরের ভিতরে, এবং হাতের কাছে পাওয়া উপাদান দিয়েই প্রাণঘাতী হামলা করে ফেলা যাচ্ছে৷

ইন্টারনেটের মাধ্যমে জিহাদি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই বেসরকারি সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে মতভেদ চলছে সরকারের৷ নিরাপত্তা বনাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে্যর বিতর্কটিও এর মধ্যে জড়িয়ে যায়৷ ওবামার সন্ত্রাস দমন উপদেষ্টা লিজা মোনাকোর মতে, আইএস-এর জিহাদি মতাদর্শকে ঠেকাতে উদারমনা ও আইএস-বিরোধী মুসলিম জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর কী ভাবে আরও বেশি করে ইন্টারনেটে তুলে আনা যায়, তা নিয়ে আরও বেশি সচেষ্ট হওয়া দরকার সরকারের৷ সহজে প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র যাতে যে কোনও ধরনের হামলাকারীদের হাতেই না পৌঁছায়, তা নিয়ে ওবামা প্রশাসনের চেষ্টা তো বহুদিনের৷ কিন্ত্ত বিরোধী রিপাবলিক্যানদের মধ্যে বন্দুক লবির জোরদার উপস্থিতি এখনও পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোনও কেন্দ্রীয় আইন আনায় বাধা দিয়েছে৷ আর ক্যালিফোর্নিয়ায় বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন কড়া হওয়া সত্ত্বেও যে হামলা আটকায়নি, সে দিকেও নির্দেশ করছেন অনেকে৷

ইন্টারনেট ও বন্দুক, দুইয়ের নিয়ন্ত্রণই যখন বিতর্কিত, তখন নজর ঘোরাতে হবে অন্য পথে৷ আর এই নতুন ভাবনার মধ্যে এমন একটা বিষয় এসে পড়ছে যা নিয়ে বরাবরই অস্বস্তিতে ভুগেছে মার্কিন প্রশাসন – ইসলামিক মতাদর্শ ও তার ছড়িয়ে পড়ার পন্থা৷ জনসনের যেমন বক্তব্য, সরকারের তরফে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে, যাতে নিজেদের ভিতরে চরমপন্থী ভাবধারায় কারও প্রভাবিত হওয়ার চিহ্ন ধরতে পারলে আগেভাগে সতর্ক হয়ে তাদের মত পরিবর্তনে সচেষ্ট হতে পারেন তারা৷

তবে এই প্রচেষ্টায় মুসলিমদের একঘরে করে দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধেও উঠে আসছে স্বর৷ একাধিক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, মুসলিম উগ্রপন্থার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হলে তা সার্বিক ভাবে ইসলামবিদ্বেষে ধুয়ো দিতে পারে, আর এই ধরনের মানসিকতাই জিহাদি মতাদর্শকে পুষ্ট করে এবং সাধারণ মানুষকে নানা ক্ষোভ থেকে ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেয়৷ শনিবারের ভাষণে কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীকে ‘ভিলেন’ না বানানোর জন্য অনুরোধ রেখেছেন খোদ ওবামাই৷ পরিসংখ্যান বলছে, ৯/১১-র পর থেকে আমেরিকায় জিহাদি সন্ত্রাসবাদের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫, এবং বর্ণবিদ্বেষী ও চরম দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদের শিকার ৪৮৷ এই দুই ধরনের সন্ত্রাসবাদে মৃত্যুর সংখ্যাই আবার একেবারে সাধারণ খুনের সংখ্যার তুলনায় নগণ্য, সেটার শিকার ২ লক্ষেরও বেশি৷ মোনাকোর কথায়, ‘আইএস পশ্চিমি দেশে মুসলিমবিদ্বেষের যে বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাতে ইন্ধন না দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে৷ আইএস সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঠিক এটাই করতে চাইছে৷’ – সংবাদসংস্থা

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.