আইএসের এত অর্থের উৎস কী?

ডিসেম্বর ৬, ২০১৫

07বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা ‍আইএস এখন আলোচনায় কেন্দ্রে। ফ্রান্সের প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার, যুক্তরাষ্ট্রে হামলার হুমকি এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী তৎ​পরতায় মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক এই জঙ্গি গোষ্ঠী নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি অনেকেরই বেশ কৌতূহল রয়েছে।

ইরাক ও সিরিয়ায় দখল করা অংশ নিয়ে আইএস একটি ‘খিলাফত’ রাষ্ট্র গড়তে চায়, ওই পুরো এলাকার আয়তন প্রায় যুক্তরাজ্যের সমান। যত জঙ্গিগোষ্ঠী আছে, সেগুলোর মধ্যে ইসলামিক স্টেটকে অর্থবিত্তে সবচেয়ে ‘ধনী’ জঙ্গি গোষ্ঠী বলে মনে করা হচ্ছে। প্রশ্নটা হচ্ছে, তাদের এই বিপুল অর্থের উৎস কী?
অস্ত্র ও যানবাহন কেনা, দলের সদস্যদের খরচাপাতি, প্রচারণামূলক ভিডিও এবং কর্মীদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠাতে আইএসের অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। এ তথ্য জানিয়ে মার্কিন অর্থ দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা ডেভিড কোহেন বলেছেন, বর্তমানে যত জঙ্গিগোষ্ঠী আছে, এর মধ্যে আইএস সবচেয়ে ধনী।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৮ সালের শেষের দিকে আইএস প্রতি মাসে ১০ লাখ ডলার আয় করত। ২০০৯ সালে প্রথম দিক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আয় দৈনিক ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছায়। পত্রিকাটি আইএসের অর্থ উপার্জনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হচ্ছে:

তেল
ইরাক ও সিরিয়ায় দখল করা তেল কূপগুলো এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম উৎস। এসব কূপ থেকে তেল তুলে তারা কালোবাজারে বিক্রি করে। এই বিকিকিনি চলে তুরস্ক সীমান্তে। তেল কিনতে সেখানে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকে কিছু ব্যবসায়ী। যেহেতু এগুলো চুরি বা অবৈধভাবে তোলা করা, তাই দামেও বেশ কম। এসব তেল পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বা বিক্রি হয়। যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। এভাবে তেল বিক্রি করে বেশ ভালোই অর্থ পায় আইএস।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আইএস অপরিশোধিত তেল ও তেলজাত সামগ্রী দালালদের কাছে বিক্রি করে। দালালেরা সেগুলো চোরাপথে সিরিয়ার কাছেও বিক্রি করে বলে জানা যায়। সম্প্রতি আইএসের তেলের স্থাপনাগুলোর ওপর বিমান হামলার ফলে তাদের অর্থের এই উৎস কমে গেছে।

কর ও চাঁদাবাজি
দিন দিন আইএস নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলের আয়তন বাড়ছে। এসব অঞ্চলে যারা বাস করে, তাদের ওপর করারোপ করে আইএস। আয়ের আরেকটি উপায় ছিল চাঁদাবাজি। পণ্য বিক্রি, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, ব্যাংকের হিসাব থেকে নগদ টাকা তোলা, বিভিন্ন কর্মচারীর বেতন, নিয়ন্ত্রিত এলাকার তল্লাশি চৌকি দিয়ে ট্রাক ঢুকলে, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহারের জন্য আইএসকে কর দিতে হয়। ব্যবহারকারীরা অবশ্য দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ পান। সিরিয়ার বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি করে বিক্রি করা এবং অমুসলিমদের কাছ থেকে চাঁদা ও লুটপাট করে বেশ ভালোই আয় করে এই জঙ্গি সংগঠনটি। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, এভাবে আইএস বছরে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন বা তিন হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার নিজেদের পকেটে পুরেছে।
যারা আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে, সেখানে ব্যবসা করে এবং বসবাস করে তাদের ‘নিরাপত্তা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাঁদা আদায় করে আইএস।
আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দুই ধরনের নিয়ম চালু আছে। যারা আইএস যোদ্ধা, তাদের পরিবার চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে বিনা মূল্যে সেবা পায়। এর বাইরের যারা থাকে, তাদের কর দিয়েই থাকতে হয়।

মুক্তিপণ ও অপহরণ
বিভিন্ন বিদেশি নাগরিকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এই জঙ্গি গোষ্ঠীটির আয়ের অন্যতম একটি বড় উৎস। জাতিসংঘের ২০১৪ সালের অক্টোবরে এক হিসেবে বলেছে, আইএস ২০১৪ সালে অপহরণের পর মুক্তিপণের মাধ্যমে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলার থেকে চার কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করে।

বিত্তশালী দাতা
আইএসের আয়ের অন্যতম উৎস ধনী দাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থ। আইএস প্রাথমিকভাবে ধনী দাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ পেয়ে থাকে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও সংযুক্ত আবর আমিরাতের বড়লোক ব্যবসায়ীরা এই জঙ্গি সংগঠনে অর্থ দান করে। কোনো কোনো হিসাবে বলা হয়েছে, এসব দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা ২০১৩-১৪ সালে প্রায় চার কোটি ডলার আইএসকে দান করেন। খবরে বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ সরকার এবং ইরানের ভয় থেকে মুক্তি পেতে ধনী ও বিত্তশালীরা আইএসের তহবিলে অর্থ দান করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি
বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে সিরিয়াও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। এগুলো চুরি করে বিক্রি করে বহু অর্থ নিজেদের তহবিলে জমা করে। সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর পালমিরার মতো অন্য শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বিক্রি করাও আইএসের অর্থের একটি উৎস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসেবে বলা হয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি করে আইএস বছরে ১০ কোটি ডলার আয় করে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ম্যাথূ লেভিড ২০১৪ সালের নভেম্বর বলেছিলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রির মাধ্যমে আইএস প্রচুর অর্থ আয় করে। এটা তাদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস।

ইরাকের ব্যাংক
মার্কিন অর্থ বিভাগের হিসাবে, ২০১৪ সালে ইরাকের উত্তর ও পশ্চিমদিকে কয়েকটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে আইএস পাঁচ লাখ ডলার অর্থ নিজের তহবিলের জমা করে।

লুটের পণ্য বিক্রি
মার্কিন অর্থ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আইএস ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মার্কিন যানবাহন ও অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ আয় করে। এ ছাড়া নির্মাণ সামগ্রী, বৈদ্যুতিক তার, আসবাবপত্র বিক্রি, আবাসন খাত, কৃষি খাত, মানবপাচার ও বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পণ্য বিক্রি করে অর্থ আয় করে আইএস।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.