জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র

ডিসেম্বর ৪, ২০১৫

11৪ ডিসেম্বর। ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই ভারতের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের হামলার পর ৪ ডিসেম্বরের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভারত-পাকিস্তান সরাসরি প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। প্ল্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে তৎপর হয়ে ওঠে।

একাত্তরের এইদিন থেকেই হানাদারমুক্ত হতে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। স্বাধীন বাংলাদেশের পথে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়যাত্রা শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সমস্ত বাধাই তখন তুচ্ছ। আকাশে, বাতাসে, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সেসব বিজয়ের খবর। আর এতে মুক্তিযোদ্ধাদের করে তোলে আরো অপ্রতিরোধ্য।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আসল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে দাবি করা হয়, এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তানকে নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবেও পায়ের তলার মাটি হারাচ্ছিল পাকিস্তান। রণাঙ্গনে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন আরেক যুদ্ধ চলছিল জাতিসংঘে। বাংলাদেশের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে তখন দারুণ উত্তেজনা।

এদিকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে লিখিত এক পত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করেন। পত্রে তারা উল্লেখ করেন, ‘আমাদের যৌথ প্রতিরোধের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হীন পরিকল্পনা ও জঘন্য ইচ্ছা ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং আমরা সফল হব।`

নিউইয়র্কে তখন বৈঠকের পর বৈঠক হল। শেষ অবধি, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে পাস হতে পারেনি। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক দেশ পোল্যান্ডও। ভোটদানে বিরত থাকল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড।

নিরাপত্তা পরিষদে হেরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। প্রস্তাবটি সেখানে পাসও করাতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মানার বাধ্যবাধকতা না থাকায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ড কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে থাকে। সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে ১১টা সেক্টরের সবগুলোতেই পালানোর পথ খুঁজছিল পাক হানাদার বাহিনী।

জামায়াতে ইসলামীর আমির আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বিরোধী গণচীনও সে সময় পাকিস্তানের পক্ষে দারুণ তৎপর।

এদিন দুপুরে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রুর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে।’ সেনাবাহিনীর প্রতি প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত হানা এবং সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেন তিনি।

কিন্তু রণাঙ্গনের চিত্র ছিল ভিন্ন। মাঠ পরিস্থিতি ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে। তারা পাক বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে অবিরাম গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে।

এদিন  মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে সিলেটের কানাইঘাট, শমশের নগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন, মেহেরপুর ও কামালপুর বিওপি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন দখলে রাখার সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকায় জোর বিমান যুদ্ধ চলে। ঢাকা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গি বিমানগুলো। পাক বিমান বাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন (২৮টি) জঙ্গি বিমান। এক স্কোয়াড্রন চীনা মিগ-১৯ আর এক স্কোয়াড্রন মার্কিন স্যাবার জেট।

পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে মিগ-১৯ বিমানগুলো পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে ছিল শুধু স্যাবারগুলো। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান বহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.