মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে যেভাবে উত্থান দাউদ ইব্রাহিমের

নভেম্বর ১৯, ২০১৫

25মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনদের হাত শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত। বলিউড থেকে শুরু করে দেশীয় রাজনীতিতেও প্রভাব রয়েছে অন্ধকার জগতের এই অধিপতিদের। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখার তৃতীয় কিস্তি আজ।

দাউদ ইব্রাহিম কাসকার- দাউদ ইব্রাহিম নামেই বেশি পরিচিত। বলিউডি সিনেমা ডন-এর সেই বিখ্যাত ডায়ালগ, ‘ডনকো পাকাড় না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়’- পুরোপুরি দাউদ ইব্রাহিমের জন্যই প্রযোজ্য। ২০১১ সালে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসে বিশ্বের শীর্ষ পলাতক অপরাধীদের তালিকায় তৃতীয় স্থানে ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালেও ফোর্বসের তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিলেন দাউদ। ভারতীয় পুলিশের পলাতক অপরাধীদের তালিকায় এক নম্বরেই রয়েছে তার নাম। মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতের রহস্যপুরুষ দাউদ। তার জীবনকাহিনি নিয়ে অন্যান্য ডনের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কোম্পানি, ব্ল্যাক ফ্রাইডে, ডি, শ্যুটআউট অ্যাট লোখানডোওয়ালা, ওয়ান্স আপন অ্যা টাইম ইন মুম্বাই

মুম্বাই পুলিশের সিআইডির হেড কনস্টেবল, ইব্রাহিম কাসকারের ছেলে দাউদ ইব্রাহিমের জন্ম ১৯৫৫ সালে দোংরি জেলার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে দাউদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে হাতেখড়ি। মুম্বাই রেলস্টেশনে এক ব্যক্তি টাকা গোনার সময় তা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেন দাউদ।

এ খবর ইব্রাহিম কাসকারের কানে পৌঁছালে ছেলেকে ব্যাপক মারধর করেন তিনি। কারণ ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ জীবনযাপন করতেন ইব্রাহিম। মুসলমানদের নবী হজরত দাউদের (আ.) নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন তিনি। আশা ছিল এ নবীর মতো তার ছেলের খ্যাতিও চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

বাবার কড়া শাসন, মারধর কোনো কিছুই দাউদ ইব্রাহিমকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে পারেনি। আশির দশকের শুরুর দিকে ১৮-১৯ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের আরেক বিখ্যাত ডন করিম লালার হয়ে কাজ শুরু করেন দাউদ। তবে অনেকে বলে থাকেন করিম নয়, বরং হাজি মাস্তানের দলে কাজ করতেন দাউদ। সে যাই হোক, একসময় দাউদ তাদের দুজন থেকেই পৃথক হয়ে যান।

এর আগে অবশ্য বড় ভাই শাবির ইব্রাহিমের হাত ধরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেছিলেন দাউদ। ওই সময় দোংরি এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিল বাসু দাদা। শাবির-দাউদ মিলে বাসু দাদা গ্রুপকে ঠেকাতে তখন ইয়ং কোম্পানি নামে একটি গ্রুপ তৈরি করেন, যা পরে ডি-কোম্পানি নামে পরিচিতি পায়। এই ডি-কোম্পানি পরে দাউদ ইব্রাহিমের পরিচালনায় আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র হয়ে ওঠে। হত্যা, গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হুন্ডি ব্যবসা সবই নিয়ন্ত্রণ করে এই ডি-কোম্পানি।

যাই হোক বাসু দাদা আর তার শিষ্যদের লোহার রড আর খালি হওয়া সোডার বোতল দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে এলাকাছাড়া করে শাবির ও দাউদ গ্রুপ। মার খেয়ে পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে যায় বাসু দাদা।  অপরাধী মহলে এর ফলে জায়গা করে নিতে আর অসুবিধা হয়নি ডি-কোম্পানির।

আশির দশকের গোড়াতেই উত্তর-পূর্ব মুম্বাইয়ের ডন ভরদরাজন মুদালিয়ার চেন্নাইয়ে পালিয়ে যায়। আর হাজি মাস্তানও তখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে তখন করিম লালার নেতৃত্বাধীন পাঠানদের রাজত্ব। শাবির-দাউদ দুই ভাই তখন মুম্বাই নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন দেখছে। একপর্যায়ে লালার গ্রুপের সঙ্গে শাবির-দাউদ গ্যাংয়ের ক্ষমতা দখল নিয়ে যুদ্ধ বেধে যায়। মুম্বাইয়ের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম গ্যাংওয়ার।

অবস্থা প্রতিদিনই খারাপের দিকে যেতে থাকলে বিচলিত হয়ে পড়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড অপরাধীরা। এই অবস্থায় এগিয়ে আসেন আরেক ডন হাজি মাস্তান। উভয় পক্ষের কাছেই মাস্তানের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত পবিত্র কোরআন ছুঁয়ে দুই পক্ষ লড়াই না করার ব্যাপারে ওয়াদা করে । তবে এই সমঝোতা নিয়ে আসলে কোনো পক্ষই সন্তুষ্ট ছিল না।

শেষ পর্যন্ত সংঘাতের দিকে হাত বাড়ায় পাঠান গ্যাংয়ের আমিরজাদা আর আলমজেব। শাবির হত্যার জন্য তারা দুজন এ সময় আগর বাজারের উঠতি সন্ত্রাসী মান্য সুরভের দ্বারস্থ হয়। বিপুল টাকার লোভে প্রস্তাবটি লুফে নেয় সুরভে। ১৯৮১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শাবির তার প্রেমিকা, স্থানীয় নাচিয়ে চিত্রাকে সঙ্গে নিয়ে বান্দ্রায় বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। প্রথম থেকেই শাবিরের গাড়ির পিছু নিয়েছিল সুরভের বাহিনী, আমিরজাদা আর আলমজেব। প্রভাদেবি এলাকার সিদ্ধি বিনায়ক মন্দিরের উল্টাপাশের একটি পেট্রলপাম্পে তেল নেওয়ার জন্য গাড়ি থামালে শাবিরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে ঘাতকরা। চিত্রাকে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত অন্যত্র সরে যেতে বলা হয়। সে সরে যাওয়া মাত্রই চতুর্দিক বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়া হয় শাবিরকে লক্ষ্য করে।

শাবিরকে হত্যার পর সুরভের বাহিনী এগিয়ে যায় ছোট ভাই দাউদের বাসভবনের দিকে। সৌভাগ্যবশত ফটক পাহারায় থাকা দাউদের প্রধান সহযোগী খালিদ পালোয়ান দূর থেকে সুরভ ও আমিরজাদার গাড়ি চিনে ফেলে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই খালিদ ও অন্যরা বাড়ির বিশাল স্টিলের গেটটি আটকে দেয়। দুই পক্ষের গোলাগুলি বেশ কিছুক্ষণ চললেও তাতে কেউ গুরুতর আহত হয়নি। রাতের শেষ প্রহরে দাউদের কানে যায় শাবিরের মৃত্যুর খবর। এই খবরে প্রায় উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেন দাউদ। প্রতিশোধ নিতে একের পর এক পাঠান গ্যাংস্টারকে হত্যা করা হয়। করিম লালার ভাইপো সামাদ খানকেও হত্যা করে দাউদের বাহিনী। পরবর্তী ১০ বছরে এ গ্যাংওয়ারে কমক্ষে ৫০ জন পাঠান গ্যাংস্টারকে হত্যা করা হয়।

শাবির হত্যার সাত মাস পর এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মুম্বাইয়ের একটি আদালতে শুনানি চলাকালে আমিরজাদাকে গুলি করে হত্যা করে ডি-কোম্পানির সদস্য ডেভিড।

দাউদের একের পর এক হত্যাকাণ্ডে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে সুরভ বাহিনী। প্রাণে বাঁচতে সুরভে ও তার প্রধান সহযোগী মুনির পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে দাউদের বাহিনীর হাতে ধরাও পড়ে মুনির। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সুরভে সময়মতো পৌঁছে ছিনিয়ে নেয় মুনিরকে। গুজব রয়েছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিয়ে সুরভেকে এনকাউন্টার করার আদেশ আদায় করে দাউদ।

১৯৮২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াদালার আম্বেদকার কলেজে ওত পেতে থাকা পুলিশ সদস্যরা হামলা করে সুরভের ওপর। মুম্বাইয়ের ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম এনকাউন্টার।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.