সামরিক অভিযান নয়, আইএস দমনে যেতে হবে মূলে
নভেম্বর ১৮, ২০১৫ লড়াইটা শেষ পর্যন্ত জিতেই যাচ্ছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। সবই যেন চলছে একে বার পরিকল্পনামাফিক। যেমনটি চেয়েছিল আইএস। প্যারিসে নির্বিচারে নিরীহদের উপরে আক্রমণ। শতাধিক প্রাণহানি। সারা বিশ্ব উত্তাল। উত্তরে ফ্রান্স-সহ পশ্চিমী বিশ্বের প্রতি-আক্রমণ। এক দিকে উগ্র মৌলবাদ। অন্য দিকে, পশ্চিমী বিশ্বের রণহুকার। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলান্দে তো যুদ্ধ ঘোষণা করেই দিয়েছেন। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বিমান হানা। ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’-এর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘতর। তা দেখে দলে আরও ভারী হয়ে উঠবে আইএস। মাঝে পড়ে থাকবে এই সমস্যার আঁতুর মধ্য এশিয়ার মূল দ্বন্দ্বগুলি।
তুরস্কে জি-২০ সম্মেলনে আইএস-কে নির্মূল করার ডাক দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সায় মিলিয়েছেন সম্মেলনে যোগ দেওয়া প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা। দ্বিমত নয় রাশিয়া। মিশরের শার্ম অল-শেখ থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ-গামী রাশিয়ার বিমান ধ্বংসের পিছনেও যে আইএস-এর হাত। সব মিলিয়ে যেন আইএস-এর বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে পশ্চিমী বিশ্ব। ঠিক যেমন আল-কায়দার বিরুদ্ধে জোট গড়েছিল আমেরিকা।
আজ সে ভাবে আল-কায়দার নাম সামনে আসে না। হিংসা, রসদ, এলাকা দখল— নানা সূচকে আল-কায়দাকে বেশ কয়েক কদম পিছনে ফেলে দিয়েছে আইএস। সম্প্রতি এর সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে পশ্চিমী বিশ্বের বুকের ভিতরে আঘাত হানার দক্ষতা। সব মিলিয়ে উগ্র মৌলবাদীদের চোখের মণি হয়ে উঠেছে সংগঠনটি। আইএস-এর এই উঠে আসার পিছনে রয়েছে আল-কায়দাকে দমন করতে ব্যবহৃত পশ্চিমী রণনীতি। শুধু নেতাদের নির্মূল করে, অর্থ, অস্ত্র-সহ রসদ জোগন বন্ধ করেই মৌলবাদকে দমন করা সম্ভব নয়। তাকাতে হয় দ্বন্দ্বের বৃহত্তর প্রেক্ষিতটির দিকে। অদ্ভূত ভাবে আমেরিকা-সহ পশ্চিমী বিশ্ব এই উগ্র মৌলবাদের সমাধান করতে এই বৃহত্তর ছবিটির দিকেই নজর দেয় না। এই সীমাবদ্ধ রণনীতি মৌলবাদের গোড়ায় পৌঁছতে পারে না। এই চক্রটি খুব ভাল বোঝেন আইএস-এর স্বঘোষিত প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি-র মতো মৌলবাদী নেতারা। সেটিকে ব্যবহারও করেন সফল ভাবে।
নানা দ্বন্দ্বে দীর্ণ মধ্য এশিয়া। মাঝেমধ্যেই এই দ্বন্দ্বগুলি হিংস্র রূপ নেয়। তবে সবচেয়ে প্রকট যুগ যুগ ধরে লালিত শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব। যাতে জড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমী বিশ্ব, ব্যবহারও করেছে নিজের স্বার্থে। আর এই সব দ্বন্দ্বের ফাঁক গলেই গড়ে ওঠে আল-কায়দা, আইএস। আফগানিস্তানে ’৮০-র দশকে রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তার অধুনা মৌলবাদের যে বীজটি বুনেছিল, আল-কায়দা নামে তা মহীরূহে রূপান্তরিত হয়। আসে ৯/১১-র বিধ্বংসী হামলা। বদলায় আল-কায়দাকে নির্মূল করতে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের একবগ্গা অভিযান। প্রথমে আফগানিস্তান। পরে সাদ্দাম হুসেনের কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র আর আল-কায়দা যোগের দাবি নিয়ে ইরাকে।
সাদ্দাম হুসেন এক নায়ক, অত্যাচারী শাসক। এ নিয়ে হয়তো সাদ্দামের সমর্থকেরাও দ্বিমত হবে না। কিন্তু সাদ্দাম এক ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছিলেন। ২০০৩-এ আচমকা করে সামরিক অভিযানে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা গেলেও স্থিতাবস্থাটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। দীর্ঘ দিন চাপা থাকা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বটি প্রকট হয়ে ওঠে। মধ্য এশিয়ার এই প্রধান দ্বন্দ্বটি ধিকধিক করে জ্বলতে থাকে। এই অঞ্চলের দেশগুলিকে শুধু বিচ্ছিন্ন করেই রাখে না, একে অপরের ক্ষমতা খর্ব করার লড়াইয়ে জড়িয়ে রাখে। এই দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা রয়েছে। মার্কিন অভিযানের হাত ধরে ইরাকের শিয়াদের ক্ষমতায়ন তাই সুন্নিদের সন্ত্রস্ত করে তোলে। সুন্নিদের সেই অস্তিত্বের সঙ্কটের বহিঃপ্রকাশ ইরাকি সরকার বকলমে আমেরিকার বিরুদ্ধে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা। এই পরিবেশেই আইএস-এর পূর্বসূরী ‘আল কায়দা ইন ইরাক’-এর জন্ম। সলতে পাকানোর দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও ইরাকের জাতি বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটটি তৈরি না হলে ‘আল কায়দা ইন ইরাক’-এর বিকাশ হত না কি না তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। জবাবে সুন্নিদের কাছে টানা, তাঁদের অভাব, অভিযোগগুলির দিকে নজর দেওয়ার বদলে সামরিক পথকেই বেশি আঁকড়ে ধরা হয়েছে। না হলে ২০০৬-এ মার্কিন বিমান হানায় ‘আল কায়দা ইন ইরাক’-এর নেতা আল জারকৌয়ই-র মৃত্যুর পরে সংগঠনটির প্রায় মুছে যাওয়া অবস্থা থেকে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় ফিরিয়ে আনতে পারতেন না আবু বকর আল-বাগদাদি। সন্ত্রাস দমন করতে ২০০৭-এ মার্কিন সহায়তায় সুন্নিদের কাছে টানার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু ২০১১-এ মার্কিন সেনা তড়িঘড়ি ইরাক ছাড়তেই প্রধানমন্ত্রী মালিকির নেতৃত্বে শিয়া আধিপত্যবাদ চরমে ওঠে। নিজের মন্ত্রিসভার সুন্নি মন্ত্রীদেরও জেলে পাঠাতে কসুর করেননি মালিকি। যার ঠিক উল্টো পিঠ আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বে ইরাকে সন্ত্রাসের বান ডাকা। যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সাহায্যের জন্য শিয়া ইরানের হাত ধরতে চান মালিকি। যা ইরাকের সুন্নিদের তো বটেই, সৌদি আরবের নেতৃত্বে সু্ন্নি দেশগুলিকেও সন্ত্রস্ত করে তোলে। আইএস-এর বিকাশের রাস্তাকে আরও পরিষ্কার করে দেয়।
একই সময়ে প্রতিবেশী সিরিয়া-য় তখন একই দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে। সংখ্যালঘু শিয়াদের (আলওয়াতি) আসাদ সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছিল সিরিয়া। যেখানে আবার সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অচিরেই শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। পাখা মেলে আইএস। শুধু কি আইএস? না, এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে শিয়া মিলিশিয়া থেকে হিজবুল্লাও। আইএস-এর হত্যালীলা নিয়ে সরব হলেও এই সংগঠনগুলিও কিন্তু পিছিয়ে নেই। আজ পশ্চিমী বিশ্বের সামনে আইএস বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিলেও কাল এদের মধ্যে অন্য কেউ আইএস-কে ছাপিয়ে যেতে পারে।
তাই আইএস-কে দমন করতে গেলে এই মূল দ্বন্দ্বগুলিকে ভুলে গেলে চলবে না। পশ্চিমী বিশ্বের এই রণহুঙ্কার নিয়ে কিন্তু কার্যত নীরব সুন্নি দেশগুলি। সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার, কয়েক বার বিমান হানায় অংশ নেওয়া ছাড়া কার্যত আইএস বিরোধী অভিযানে নেই সুন্নি দেশগুলি। আইএস-কে সামলাতে গিয়ে ইরানের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে তারা। কারণ, রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আইএস বিরোধী লড়াইয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে ইরান। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়েছে।
এত দিন সৌদি আরব আর ইরানের এই দুস্তর ব্যবধানের মাঝে দিব্য লালিত হচ্ছিল আইএস। তাই শুধু আইএস-এর ঘাঁটিতে ক্রমাগত বোমা ফেলেই আইএস-কে নির্মূল করা যাবে না। আবু বকর আল-বাগদাদি-সহ আইএস নেতাদের হত্যা করলেও নয়। ভাবতে হবে শিয়া-সুন্নি ফাটলটিকে নিয়ে। অস্বীকার করার উপায় নেই ফাটলটি মেরামতির কাজ খুব কঠিন। কিন্তু শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব। সম্ভব এক দেশের অস্থিরতা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশের প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাকে বন্ধ করাও। সামরিক অভিযান সাময়িক স্বস্তি দিলেও পশ্চিমী বিশ্বকে দু’পক্ষকে এক টেবলে আনতে হবে। কারণ, এই দ্বন্দ্ব, প্রবণতার ফাঁক গলেই আল-কায়দা, আইএস বেঁচে থাকে, অন্য নামে অন্য সময়ে।