বাবা-মা’কে হত্যার দায়ে ঐশীর ফাঁসির রায়

নভেম্বর ১২, ২০১৫

হত্যাকাণ্ডের পর ঐশীকে আশ্রয় দেওয়ায় তার বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা দিতে না পারলে তাকে আরও এক মাস বিনাশ্রম সাজা খাটতে হবে।

হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন ঐশীর আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনি।

ঢাকার তিন নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ বৃহস্পতিবার চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

২৭ মাস আগে ওই হত্যাকাণ্ড এবং তাতে রহমান দম্পতির কিশোরী মেয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে।

ওই ঘটনা বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা এবং তাতে অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলেছিল, তেমনি ঐশীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ‘দায়িত্বহীন’ আচরণ হয়েছিল সমালোচিত।

এ মামলায় ঐশীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তার বিচার চলছে শিশু আদালতে। তদন্ত চলাকালে হাকিম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ড ও পরে লাশ সরানোর ক্ষেত্রে ঐশীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেয় ১১ বছর বয়সী এই বালিকা।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, “ঐশী পরিকল্পিতভাবে, সময় নিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সে খুনের সময় সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। আসামিপক্ষ তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। সে মাদকাসক্ত হলেও বাবা-মাকে সে হত্যা করেছিল সুস্থ মস্তিষ্কে।”

হত্যাকাণ্ডের পর ঐশী আশ্রয় নিয়েছিলেন বন্ধু রনির বাসায়। ‘অপরাধীকে’ আশ্রয় দেওয়ার অপরাধেই দুই বছরের সাজা হয়েছে তার।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রেপ্তার হওয়ার পর রনি ইতোমধ্যে ১৯ মাস হাজতে কাটিয়েছেন। সুতরাং তার দুই বছরের সাজা থেকে ওই সময় বাদ যাবে বলে আদালত রায়ে জানিয়েছে।”

অন্যদিকে ঐশীর আইনজীবী  ফারুক আহম্মদ বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা হাই কোর্টে যাবেন।

এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল। শুনানিতে তিনি আদালতকে বলেছিলেন, ভাতিজি ঐশী বাবা-মাকে খুন করতে পারে বলে তার বিশ্বাস হয় না।  বৃহস্পতিবার রায়ের পর লেতিনি বলেন, “আমি অসুস্থ। পরে কথা বলব।”

স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, আগের রাতে কোনো এক সময়ে কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সি ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে যান। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে একদিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন এই কিশোরী।

পরে তার বক্তব্যের সূত্র ধরেই রনি ও জনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সবাইকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে।

রিমান্ডের পর ঐশী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলেন, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। আদালতে তিনি দাবি করেন, বাবা-মা যখন খুন হন তখন তিনি বাসায় ছিলেন না; কারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাও তিনি জানেন না।

অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীর বয়স বিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার মাধ্যমে শিশু আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে সে সময়। বয়সের সমর্থনে খুলনার একটি ক্লিনিকের জন্মসনদও আদালতে দাখিল করেন ঐশীর আইনজীবী।

পরে আদালতের নির্দেশে গতবছর ২০ অগাস্ট ঐশীকে পরীক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, এই কিশোরীর বয়স ১৯ বছরের মতো।

২০১৪ সালের ৯ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। তাতে বলা হয়, বাবা-মা’কে ঐশীই হত্যা করেন; আর অন্যরা তাকে সহযোগিতা করেন।

মহানগর দায়রা জজ আদালত গত বছরের ৬ মে ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে। পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গেলে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকার তিন নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম সাজেদুর রহমান আবারও অভিযোগ গঠন করে ঐশীদের বিচার শুরু করেন।

বাদীপক্ষে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ঐশীর চাচাসহ ৩৯ জনের জবানবন্দি শোনে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে  বিশেষ প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান এবং আসামিপক্ষে  ফারুক আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান রানা গত ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন তিনি। অপর দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।

জনি এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই কারাগারে ছিলেন। আর রনি ছিলেন জামিনে।

রায় উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে প্রিজনভ্যানে করে ঐশীকে আদালতে নেওয়া হয়। পরে তিন আসামির উপস্থিতিতেই বিচারক রায় ঘোষণা করেন।

এই জোড়া খুনের মামলায় ঐশীকে সহযোগিতার অভিযোগে গৃহকর্মী সুমির মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। গত বছরের ২০ মে অভিযোগ গঠন করে তাকে জামিন দেন শিশু আদালতের বিচারক জাকিয়া পারভিন।

পরে গত বছরের ১ জুন গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে মুক্তি পায় সে।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.