কিংবদন্তীশিল্পী ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণ দিবস আজ

নভেম্বর ৫, ২০১৫

19‘ও মালিক সারা জীবন কাঁদালে যখন এবার মেঘ করে দাও’। তার এই প্রার্থণা শুনতে পেয়েছিলেন মালিক, তিনি এখন মানুষের জন্য মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। কারণ, তিনি আজীবন গেয়েছেন ‘মানুষ মানুষের জন্য’। তিনি বাংলা গানের প্রবাদপুরুষ ভূপেন হাজারিকা। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর তিনি মৃত্যুর হাত ধরে হয়ে যান আকাশের মেঘ। তখন তার বয়স ৮৬ বৎসর। ‘আমি এক যাযাবর’ এর সুরেলা কন্ঠের যাদুকর হয়ে যান অনন্ত পথের যাযাবর। আকাশের মেঘের মতোই দূরে চলে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

কিংবদন্তীশিল্পী ভূপেন হাজারিকার প্রয়াণ দিবস আজ। অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেওয়া এই মহান শিল্পীর শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আসামিয়া, ফোক, বলিউড এবং আধুনিক গানকে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। বাংলা ও হিন্দি দু’ভাষাতেই  আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা পায় ভূপেনের গান। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকায় এসেও ভক্ত শ্রোতাদের মাতিয়ে যান তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের বাঁধন ছিল তার।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিয্দ্ধু চলাকালে এই শিল্পীর সঙ্গীত স্বাধীনতাকামী জনগণের মাঝে যে আশার  আলো জাগিয়েছিল তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।  তিনি ৩৩টি চলচ্চিত্রে  কণ্ঠ দেন। সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন একাধিক ছবিতে। তার গান গাওয়া ও সঙ্গীত পরিচালনায় বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রুদালী’, ‘দামান’, ‘দারমিয়া’, ‘গজগামিনী’ প্রভৃতি। সর্বশেষ ২০০৬ সালে ‘চিঙ্গারী’ চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দেন তিনি। বাংলাদেশে ভীষণ জনপ্রিয় ভূপেন হাজারিকা ১৯৭৩ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামে যৌথ প্রযোজনায় ছবিতে কণ্ঠ এবং ১৯৭৭ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির সংগীত  পরিচালনা করেন। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই গান লিখে সুর দেওয়া শুরু করেন ভূপেন হাজারিকা।

বাংলাদেশের ‘সীমানা পেরিয়ে’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন ভূপেন হাজারিকা। এ চলচ্চিত্রের বিখ্যাত গান ‘মেঘ থম থম করে’ এখনও সবার মুখে মুখে। ভূপেন হাজারিকা ১৯৪২ সালে গোহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাস করেন এবং পরে  ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সাহিত্যে  অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে তিনি আসাম সাহিত্য-সভার সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৯২ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার আজীবন অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৫ সালে আঞ্চলিক চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ২০০৯ সালে আসাম-রদ্ন, ২০০৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমি অ্যাডওয়ার্ড প্রভৃতি, সেন্সর বোর্ড ও জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ  সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি রে..  ছুটে ছুটে আয়’, গানে গানে এমন আকুতির কথা ছিল বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী ভূপেন হাজারিকার। তার  দরাজ কণ্ঠে আরো বেশ কিছু গান মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়, যেমন-‘‘বিস্তীর্ণ দু’ পাড়ে’, ‘সাগর সঙ্গমে’, দোলা হে দোলা’, ‘প্রতিধ্বনি  শুনি’, ‘আমায় একটা সাদা মানুষ দাও’, ‘শরৎ বাবু খোলা চিঠি দিলেম তোমার কাছে’, ‘গঙ্গা আমার মা-পদ্মা আমার মা’, ‘জীবন নাটকের নাট্যকার কি বিধাতা পুরুষ’-প্রভৃতির জীবন অনুসন্ধানী গান ছিল ভূপেন হাজারিকার। ভূপেনের গান মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছে।

১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের সাদিয়া গ্রামে জন্ম তার। একাধারে তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়ে গেয়েছেন অসংখ্য গান। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার গানে আকৃষ্ট হয়েছেন শ্রোতারা। শৈশবেই তার স্বতন্ত্র গায়কী প্রতিভা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

বারবার ভীষণভাবে সময়কে ছুঁয়ে দিয়েছেন কিংবদন্তি এই গায়ক। তিনি গেয়েছিলেন, ‘খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে/ তোমার গফুর মহেষ এখন/ কোথায় কেমন আছে তুমি জানো না/ হারিয়ে গেছে কোথায় কখন তোমার আমিনা/ শরৎ বাবু এ চিঠি পাবে কিনা জানি না আমি/ এ চিঠি পাবে কিনা জানি না।’

সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা গানগুলো তাকে বেশি জনপ্রিয় করে। আমজনতার কথা তুলে ধরায় তার গানের মধ্যে জনগণ বারবার নিজেদের খুঁজে পেয়েছে। সহানুভূতি হারা মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, `মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না`। আবার ‘দোলা হে দোলা হে দোলা/ হে দোলা আঁকা-বাঁকা পথে মোরা/ কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই/ রাজা মহারাজাদের দোলা/ ও দোলা আমাদের জীবনের/ ঘামে ভেজা শরীরের বিনিময়ে পথ চলে দোলা/ হে দোলা হেইয়ানা হেইয়ানা হেইয়ানা হেইয়া’ কার মনে না দোলা দেয়।

আবার ’মোর গায়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে/ নিশিথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি/ কান পেতে শুনি আমি বুঝিতে না পারি/ চোখ মেলে দেখি আমি দেখিতে না পারি/ চোখ বুজে ভাবি আমি ধরিতে না পারি/ হাজার পাহাড় আমি ডিঙুতে না পারি’ এর প্রতিধ্বনি জাগে না কার মনে। আবার ভালোবাসার কথা বলতে বলতে তিনি উচ্চারণ করেছেন- ‘মোরা যাত্রী একই তরণীর সহযাত্রী একই তরণীর/ যদি সংঘাত হয় তবে ধ্বংস হবে গর্ব মোদের প্রগতির/ প্রভু চোখ মেলে চাও দেখ স্বর্গ হতে,/ ও মহা প্রভু, কী শুন্য সাগর,/ এই তরী পৃথিবীর সারা মানবজাতির।’

দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে হাজারিকার সঙ্গী ছিলেন চলচিত্রকার কল্পনা লাজমি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, `ভূপেন শুধু গায়ক ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান সমাজসংস্কারকও। ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.