‘মনের মানুষ’ সিনেমার লালন কোন লালন?

অক্টোবর ১৬, ২০১৫

11ফকির লালন শাহ এর ১২৫তম তিরোধান দিবস আজ। বাংলাদেশ তথা প্রাচ্য দর্শনের এ মহান দার্শনিক ও সঙ্গীতগুরুর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা, গবেষণা, নির্মাণ কম হয়নি। তবু লালন অজানাই থেকে যান। তার পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি যেন কেবল তার সৃষ্টির ভেতরেই। তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর রচনা অবলম্বনে গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন চলচ্চিত্র ‘মনের মানুষ’। সেখানে কতটুকু ধরা পড়েছিলেন লালন? কিভাবে তার উপস্থিতি এঁকেছেন লেখক ও নির্মাতা? তাই অনুসন্ধাণ করেছেন কবি ও সঙ্গীতশিল্পী অরুপ রাহী

 

‘এখন বড়লোকে ‘লালন’ করে, মধ্যবিত্তে ‘লালন’ করে, গরীবে ‘লালন’ করে, বুদ্ধিজীবী ‘লালন’ করে, সংস্কৃতি কর্মী লালন করে, রাজনীতিবিদ ‘লালন’ করে। সব কিছুর পাশাপাশি একটু ‘লালন’ করা। দরকার হলে একটু বেশি করা। ‘বিপ্লবী’ও ‘লালন’ করে, অ-বিপ্লবীও। এখন ক্লোজআপ ওয়ান-এ ‘লালন’, কর্পোরেট স্পন্সরড মিউজিক ফেস্টিভালে ‘লালন’, বাংরেজি উচ্চারণে ‘লালন’, ইংরেজি উচ্চারণে ‘লালন’, রাবীন্দ্রিক উচ্চারণে লালন, কসরতি ফোক উচ্চারণে ‘লালন’। ফিউশনে লালন, ট্রাডিশনাল কম্পোজিশনে লালন। এই লেখকও লালন ফকিরের গান করেন। বঙ্গ লালনময়! বঙ্গ কি লালনভাবের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে?’

বিশাল সব সার্কুলেশনের পত্রিকা-টেলিভিশনে বিশাল প্রচারণার মধ্যে দিয়া ‘মনের মানুষ’-এর আগমন। প্রযোজক-প্রচারকরা এমন অবস্থা করলো যে এমন যে এই ছবি না দেখলে আর্ট-কালচার-জীবন-যৌবন বৃথা যায়। বড় বাজেট, কর্পোরেট স্বার্থ আছে, এমন কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে বঙ্গে এ আর কোন নতুন কথা না। এই ছবিটা বানানো হইতেছে এমন একটা সময়, যখন বঙ্গের, বাংলাদেশের, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, ফাল্গুন, বৈশাখ, লালন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, দিনবদল, হাতবদল, গদিবদল-সবই যেন ‘সুমহান’ কর্পোরেট চেতনায় সমুজ্জ্বল। কর্পোরেট রঙে রঙিন। ‘মনের মানুষ’-এই রঙে নিজে শুধু রঙিন নয়। অন্যকেও এই রঙে রাঙাতে চায়। কী ভাবে? এই প্রশ্ন আমরা মাথায় রাখলাম।

বাজারে ‘মনের মানুষ’ এর আওয়াজ শুনে মনে হইল, যে উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি নির্মিত হল, সেটা পড়া দরকার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসটা কিনে এনে পড়লাম। আগে পড়লাম ব্যাক-ফ্ল্যাপে জগতখ্যাত ইতিহাসবিদ রনজিৎ গুহ’র মন্তব্য। পুরাটাই উদ্ধৃত করা দরকার, আমাদের আলোচনার শেষে কাজে লাগবে:
মনের মানুষ” পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। লালন এবং সাধারণভাবে এ ধরনের লৌকিক ধর্ম সম্পর্কে তোমার চিন্তার সঙ্গেও খানিকটা পরিচিত হবার সুযোগ পাওয়া গেল। এ ধরনের লেখা যে কী শক্ত তা বুঝলাম ‘লেখকের বক্তব্য’ পড়ে। সত্যিই তো এরকম কাহিনী রচনায় ইতিহাস-বোধকে কল্পনার আশ্রয় নিতেই হবে, এবং তুমি যেভাবে নিয়েছ তা নিয়ে আপত্তির কারণ কিছু নেই। বরং আমার মনে হয় যে তথ্যগত ভিত্তি সংকীর্ণ হলেও একটা ঐতিহাসিক কাহিনীর ঐতিহাসিকতা কী করে বজায় রাখা যায় সেই দুঃসাহসিক চেষ্টার সাফল্য এ উপন্যাসে সত্যিই বিস্ময়কর।
দেড় যুগ হলো, আমি ফকিরি-সহজিয়া ধারার প্রেমে মজে আছি। ফলে, উপন্যাসটা বিকট, নিরস, বিস্বাদ লাগলেও এর সামাজিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ছবিটা দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

২.
যেসব চরিত্রে সঙ্গে লালন ফকিরের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে উপস্থিত ও প্রমাণিত, তাদের মধ্যে মধ্যে সিরাজ সাঁই, দুদ্দু, মনির উদ্দিনের নাম এবং হাজিরা দেখতে পাই উপন্যাস এবং ছবিতে। বাকী বেশির ভাগ চরিত্রই অনুপস্থিত। বিশেষত বিশাখা, মতিজান ফকিরানী, মলম শাহ, প্যারীনেসা, ভোলাই শা প্রমুখের অনুপস্থিতি রেখে, নতুন, রাবেয়া, কালুয়া, কমলি ইত্যাদি অচেনা, আরোপিত অনেক চরিত্র হাজির করে কথিত ‘আনন্দবাজার’ নির্মাণ সুনীল-গৌতমের ‘কল্পনা’শক্তির প্রমাণ দেয় বটে।
সেখানে কি কি হয়? যেমন:
‘এখানে যার যেমন খুশি ধর্ম মানে। এমনকী একজন মানুষ দুই ধর্মও মানতে পারে। মানে তো দেখি। আর আমরা গান নিয়া থাকি….’
( ‘গান’ নিয়া থাকি। যেন গানের কোন মানে নাই। দেশ-কাল-পাত্র নাই। সমাজ রাজনীতি নাই। গান ‘ভাল’ জিনিস!)
‘ওগো আমার বিদ্যা ফুরায়ে গেছে, আর কিছু বলার সাইধ্য নাই … এসো গান ধরি….তোমরাও গান গাও’.. খোলা আকাশের নীচে শুরু হয় গান’..
( অসহায়ের গান সহায়! অথচ, ফকিরি-সহজিয়া ধারায় গান হল তর্ক-আলোচনা-বাহাস এর অন্যতম মাধ্যম)
‘এসব তত্ত্বও আমি বুঝি না। গোস্তাকি মাফ করবেন, একটা কথা কব? আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কথা দিয়া অনেক কিছুই বুঝাইতে পারি না। তখন একটা গান মনে আসে। একটা গান শুনাতে পারি?’….
( এই কথা অনারঞ্জন। সংকোচন। গান এই ধারায় ‘মনে আসে’ না। গান এই ধারায় সক্রিয়তার চর্চা ও উদাহরণ।)

সিরাজ সাঁই তরুণ লালনকে “সঙ্গ” দেয়ার জন্য একজন নারীকে ডাকলেন। ক্যামেরায় সেই নারীকে দেখা গেল। চোখে মুখে প্রচণ্ড কামুকতা। এসেই লালনকে জড়িয়ে ধরে একটা ঘরের দিকে যেতে থাকল। লালন যেন অবশ কিংবা বশ হয়ে গিয়েছেন। তার সাথে সাথে চলেছেন। হঠাৎ সিরাজ সাঁই লালনকে পিছু ডাকলেন। যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও লালন সিরাজ সাঁই এর কাছে ফিরে আসলেন (সিনেমা হলে প্রচণ্ড হাত তালি)। সিরাজ সাঁই লালনকে সাবধান করে বললেন, যে কাজ তুমি করতে যাচ্ছ সে কাজ বিপদজনক। তোমাকে বিন্দু ধারণ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরের দৃশ্যে সেই নারী ঘনিষ্ঠ অবস্থায় লালনকে জিজ্ঞেস করে, পারবে অমাবশ্যায় পূণির্মা জাগাতে?’

এর আগের একটা দৃশ্যে দেখা যায় ‘সংসারের মায়ায় আচ্ছন্ন’ তরুণ লালনকে স্থির করার জন্য সিরাজ সাঁই একজন সাধন সঙ্গীনি জুটিয়ে দেয়ার কথা বলছিলেন। নারী-পুরুষ বিচার ও নারীপুরুষ সম্পর্ক নিয়ে ফকিরি-সহজিয়া মতে সুনির্দিষ্ট চিন্তা ও অনুশীলন আছে। সাধনসঙ্গী-সঙ্গীনি নির্বাচনের পথ-পদ্ধতি আছে। সেটা জোর করে জোড় মিলায়ে দেয়া না। মনের মানুষে সিরাজ সাঁই এবং লালন ফকিরকে দিয়ে তাই করিয়েছেন সুনীল এবং গৌতম।

লালন হেসে বলে, ‘আমার তো নিজের বোধবুদ্ধি কিছু নাই। তাই অন্তরের কথার উপর নির্ভর করি। হাতটা সরাও কমলি! কমলি এবার বেপরোয়া হয়ে গিয়ে আরও হাত বাড়িয়ে লালনের পুরুষাঙ্গটি চেপে ধরল। সেটি উত্থিত তো বটেই, লোহার মত কঠিন। কমলি হি হি করে হেসে বলল, এই যে, এই যে, তোমার বাসনা আছে ষোল আনা। তুমি ভাবের ঘরে চুরি করো।’ লালন বলল,শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, কিন্তু মন যদি না জাগে, তাইলে কি প্রকৃত মিলন হয়? শরীরে আগুন লাগে, কিন্তু বাসনার শিখা….আরে, এই সব কথাই বা আমি কইলাম ক্যামনে? কি যে হয় আমার!’….

( লালনের নিজের বোধ বুদ্ধি নাই! … বার বার লালন নিজেরে একজন আলা-ভোলা-বোধ- বিবেচনাহীন মানুষ হিসেবে অন্যের কাছে তুলে ধরতেন নাকি? যৌনতার যেই ধারণা ও চর্চা সুনীল/গৌতম, তাদের উপন্যাস সিনেমার অপরাপর চরিত্ররা করতে পারে, তাই এখানে জোর করে চাপিয়ে দেয়া। সুনীলের বর্ণনা বেশ খাই খাই। এই ধরনের বর্ণনা উপন্যাসের কাটতি বাড়াইতে এইখানে দিছেন সুনীল বাবু, এই অনুযোগ প্রণিধানযোগ্য। দ্বিতীয়ত, দেহ-মনের সাধনা ফকিরি-সহজিয়া ধারায় অন্যতম প্রধান সাধনা। লালন, এই দৃশ্য ও বর্ণনা মতে, এই সাধনার কিছুই জানেনা মনে হইতেছে। দেহের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ তার নাই যেন। তৃতীয়ত, শরীর-মনের যেই ধরনের পার্থক্য সুনীল-গৌতম করাইলেন লালনরে দিয়া, তা ফকিরি-সহজিয়া মতে সাব্যস্ত না।)

‘নারী হল আনন্দ সহচরী। মহামায়া। …নারীর অন্তরে ঈর্ষা…’…. ‘ ; ‘কিন্তু আমার মনের মধ্যে যে আরেকটা মানুষ আছে, সে আমারে নির্দেশ দেয়। সে আমারে কয়, রমনী রত্ন অতি দুর্লভ।…’

( নারী সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে ফকিরি-সহজিয়া ধারার চিন্তা-চর্চা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে, বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে এই রকম অসংলগ্ন উক্তি সিরাজ এবং লালনকে দিয়ে করানো সম্ভব। ফকিরি-সহজিয়া মতে, স্থুলদেহী, আমরা সকলেই নারী। লালন বলেন, ‘লিঙ্গ থাকিলে সেকি পুরুষ হয়’? কিংবা, ‘স্ত্রীলিঙ্গ-পুংলিঙ্গ-নপুংসক- এ তিন ভাবে না হবে ভাবুক’ ইত্যাদি। আমরা সবাই প্রকৃতি। পুরুষ হল চেতনসত্তা। আদি সাংখ্য প্রকৃতিকেই আদ্যশক্তি মনে করে। ফকিরি সহজিয়া ধারা নারীকে প্রেমের গুরু হিসেবে মান্য করে, কারণ, দেহ সাধনায় নারী-ই পুরুষের সহায়। তা ছাড়া নারী-পুরুষ সম্পর্কে ফকিরি সহজিয়ার একটা প্রগতিশীল/পরিবর্তনশীল ধারণা ও চর্চা আছে। তাদের এসব ধারণা ও চর্চা তৎকালীন সমাজ-বিবেচনায় বুঝতে হবে। কলকাতার, ব্রাহ্মণ্যবাদী, বেদপন্থী, কাষ্ঠবৈষ্ণব প্রভাবিত ‘হিন্দু’ সমাজ যেভাবে নারীকে দেখেছে, তা লালন বা সিরাজ সাঁইয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এই বই এবং ছবিতে।)

-জ্যোতিরিন্দ্র বললেন: ..’শচীন বাবু, এই ফকিরের যে গ্রাম, তা সব নিস্কর জমি হিসাবে পাট্টা করে দিন। আমি থাকতে থাকতেই যেন সই সাবুদ হয়ে যায়।…’

(জ্যোতিন ঠাকুর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। লালন নিজে চেয়েছিলেন বলে জানা যায় না। পরে লালন শিষ্য মনির উদ্দিন আখরার জমি নিষ্কর করার দরখাস্ত করেন। এ নিয়ে শিষ্যদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল।)

…বাংলা সংস্কৃতিকে তো আপনারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন… অনেক কথা হয়েছে, এবার গান ধরুন’..

( বাংলা সংস্কৃতিকে গরীব-বাউল-ফকিররা বাঁচায়া রাখছে! আর তার স্বীকৃতি পাইতে হইলো জমিদার বাবুর কাছ থিকা। এই স্বীকৃতি চাইল কে? গরীব-সাবঅল্টার্ন কি সংস্কৃতি বাঁচানোর কোন প্রজেক্ট কোনো কালে নেয়? নাকি এইটা মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত-হাই কালচারের প্রজেক্ট? আর গান একটা আলাদা ব্যাপার- কথার সঙ্গে গানের সম্পর্ক নাই!)

-সময় গেলে সাধন হবে না’ গানটা কমলি যে প্রেক্ষিতে গায়, তার সঙ্গে এ গানের অর্থের কোনো সামঞ্জস্য নাই। ছবিতে কোন গানই প্রেক্ষিতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।

এই রকম আরো অনেক আছে। উল্লেখ বাহুল্য।

এই বই এবং ছবিতে যা লক্ষ্য করা গেল:

-বই এবং সিনেমা কোনটাই পুরাপুরি বাস্তব তথ্য ভিত্তিক না। বানানো। লেখক-পরিচালকের মনের মাধুরি মেশানো। লালন এবং সিরাজ সাঁই এর জায়গায় অন্য কোনো নাম বসায়া দিলে এই বই-ছবি যে লালনকে নিয়া, তা আর বোঝা যাবে না।

তবু, ধইরা নিলাম এইটা লালন ফকির এবং তার সময়কে নিয়া। তা হইলেও, কোনো এক জঙ্গল-অরণ্যে গিয়ে লালন তার সঙ্গীরা মিলে ‘আনন্দ বাজার’ গড়ে তুললেন- খুবই অ-ইতিহাস সম্মত কথা। ফকিরি-সহজিয়া মতের সাধকরা জঙ্গলে যান না। লালন সম্পর্কে প্রচলিত গল্পকথাতেও তার কোন আন্দাজ-অনুমান পাওয়া যায় না। তারা সমাজ-সংসারে থেকে তাদের সাধন-ভজন-করন করেছেন, করছেন।
‘লৌকিক ধর্মের’ যে চেহারা ‘মনের মানুষ’ এ সুনীল হাজির করেন, তা বাউল-ফকির-সহজিয়ার সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে বেমানান। ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, আরো বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে তাদের সম্পৃক্ততার ধরন ও করন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাহীন। দুই-একবার কাঠমোল্লা আর কাঠ-পুরুত এর সাথে বাহাস দিয়ে বাউল-ফকির-সহজিয়ার অপজিশনাল চরিত্র বোঝা যায় না। যেই কল্পনার প্রশংসা রনজিত করলেন, সন্দেহ নাই, তার একটা শক্তি আছে। কিন্তু যেহেতু ঐতিহাসিক প্রামাণিকতার বাইরেও কল্পনার বিস্তার সুনীল ঘটিয়েছেন, তখন, দুইটা প্রশ্ন হাজির হয়:

১.সুনীল তার কল্পনার বিস্তারে কোন পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন,
২.সুনীলের চেতন-অচেতন-রাজনৈতিক অবস্থান কোন ধরণের কল্পনা করতে চান।

কল্পনার রাজনীতি আছে। বাস্তবতার পরিবেশনেরও। লালনকে যদি কায়েমী স্বার্থের বিরোধী (ড়ঢ়ড়ংরঃরড়হধষ) সাধক মনে করি, তাইলে সাবঅল্টার্ন স্কুল খ্যাত রনজিত গুহ-র এই মন্তব্য বন্ধুকৃত্য, অতিশয়োক্তি, নাকি সঠিক মূল্যায়ন? আমি মনে করি প্রথম দুইটা।
ছবির রঙ, আলো, দৃশ্যধারণ, শব্দ- সুনীল-গৌতম এর ‘মনের মানুষ’ ফ্যান্টাসির সঙ্গে বেঈমানি করে নাই।

সিরাজ-লালন চরিত্র যেই আকারে সুনীল-গৌতম হাজির করেন, তা সুনীলীয়-গৌতমীয়ই। বা বলা যায় ঢাকা-কলকাতার কর্পোরেট এলিট যেই ভাবে লালনকে, সিরাজকে দেখে, দেখতে চায়, সেইরকম। এই লালন-এর খিদা লাগে বইলা মনে হয় না। আনন্দবাজারে খাওয়া-পড়া ভুতে জোগায়। লালনরা জঙ্গলে থাকে। জমিদারের অত্যাচার ঠেকাতে লাঠিয়াল বাহিনী গঠনে যে যুক্ত, সেই আবার বড়লোকরা ডাকলে গদগদ হয়া ড্রইংরুমে হাজির হয়। উপনিবেশ, শ্রেণী-শোষণ, লিঙ্গবৈষম্য, ধনী-গরীব বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা- এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। শুধু জাত নিয়া তারে একটু বেচইন দেখা গেল। আর কোন এক হাওয়াই ‘মনের মানুষ’-এর নির্দেশে প্রেক্ষিতহীন নাচ-গানে সময় কাটায়। মোল্লা-পুরুতরা আগে থেকেই করাচ্ছেন। বাংলালিংক নিবেদিত এই ছবিতে গৌতম সিরাজ-লালনের আরেক দফা খতনা করালেন। কর্পোরেট খতনা।

‘ফোক’ নিয়া ‘আধুনিক’-এর, বড়লোকের, কর্পোরেটের এই ‘দরদী’, ‘উন্নয়নবাদী’, ‘সেবামুলক’, ‘সোশ্যাল বিজনেস’ মূলক প্রকল্প পুঁজির ধর্মের বাইরে ঘটতেছে না। এটা পুঁজির বিস্তারের নতুন এলাকা। নতুন সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদনের মওকা। এবং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বরাবরের মতই, এই সংস্কৃতিব্যবসায়ী পুঁজি বা কালচার ইন্ডাস্ট্রি সাম্প্রদায়িকতার, বৈষম্যের, বিভেদ-এর ভেদ-কারণ পরিষ্কার করে না। বরং ছবির রঙ, আলো, দৃশ্য, শব্দ, সংলাপ, অভিব্যক্তি- নানা কিছুর প্রলেপ দিয়ে বিভিন্ন মনকে দারুন ভাবে ‘ভোক্তা’ মনে পরিণত করে। ভোগের বাসনা আপাত অপ্রধান হলে আবার সাম্প্রদায়িক মন জেগে উঠবে।

এই ভোক্তা মন সৃষ্টি সুনীল-গৌতমের সাফল্য। তার পুরস্কার নানা দিক থেকেই তারা পাচ্ছেন।

কিন্তু, ‘মনের মানুষ’ কী? কার মনের মানুষ? সুনীল-গৌতম ‘মনের মানুষ’ বলতে কী বোঝেন? সে আরেক লম্বা আলোচনা, অন্যত্র হবে। কিন্তু সিনেমায় কী বুঝানো হলো? লালন ফকির মনের মানুষের সঙ্গে মিলনের অপেক্ষায় থাকলেন, অথচ সুনীল-গৌতম দেখান যে মনের মানুষই তাকে দিয়ে কীসব কথাবার্তা বলায়। ‘মনের মানুষ’ কী আমাদের ‘অচেতন’? আমাদের ‘ইতিহাস’? সমাজ-উর্দ্ধ অলৌকিক সত্তা? ভাবাদর্শের উঁকিঝুঁকি? অস্পষ্ট থাকে ছবিতে। কিন্তু এই বই-ছবির সুনীল-গৌতমের ‘মনের মানুষ’ পরিস্ফুট এই বই-ছবিতে। কর্পোরেট পুঁজির যুগে তাদের মনের মানুষ হল কর্পোরেট ‘মনের মানুষ’। ইনকর্পোরেটেড। কর্পোরেটাইজড। কর্পোরেট বান্ধব। কর্পোরেট। কী রকম? মসৃণ, মিষ্টি, কোমল, রহস্যময়, অনির্দিষ্ট, ‘অন্যরকম’, ‘আমাদের’, ‘ভালো’, ‘মানবতাবাদী’, ‘কুল’, ‘সেক্সি’।

কর্পোরেট ‘আর্ট-কালচার’ দৃষ্টিভঙ্গি, যা কিনা সুনীল-গৌতমেরও দৃষ্টিভঙ্গি, তা দিয়া সিরাজ-লালন-বাউল-ফকির-সহজিয়াকে এ ছাড়া আর কিভাবেই বা উপস্থাপন করা সম্ভব?

(বাংলামেইল২৪ডটকম থেকে)

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.