ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় বাংলাদেশের অবস্থান এবং আদিবাসীদের অভিজ্ঞতা -মিথুশিলাক মুরমু

অক্টোবর ৮, ২০১৫

15২০১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সাড়া জাগানো রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে সাম্প্রদায়িকতার যে বিভীষিকাময় ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটির তিন বছর পূর্তি দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভের সাথে স্মরণ করা হয়েছে। রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতারা জানিয়েছেন, ‘হামলার সঙ্গে জড়িত ২০ জনের একটা তালিকা আমরা পুলিশকে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাদের আসামি করা হয়নি। যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের আমরা চিনি না।

এখন আদালতে কার বিরুদ্ধে আমরা সাক্ষ্য দেব? এতে আমাদের শত্রু আরও বেড়ে যাবে’সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ১৪১টি দেশের মধ্যে ৩০তম স্থান পাকাপোক্ত করেছে। আমরা আমাদের প্রতিবেশী ভারত, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে হারিয়ে বেশ পরিতৃপ্ত । আমাদের স্কোর ৭৮ এবং পর্যায়ক্রমে ৬৭, ৭৩, ৭৩, ৬০ এবং ৫২। যে প্রশ্নের আলোকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি রফা করা হয়েছে_ ১. আপনি যেখানে বাস করেন, সেখানকার পুলিশ বাহিনীর প্রতি আপনার আস্থা আছে?’ ২. যেখানে বাস করেন, সেখানে রাতের বেলা একাকী হাঁটা নিরাপদ মনে করেন?’ ৩. গত ১২ মাসের মধ্যে আপনার বা পরিবারের কোনো সদস্যের টাকা-পয়সা বা সম্পদ চুরি হয়েছে?’ এবার একটু চোখ বন্ধ করে আদিবাসী নাগরিকদের কথা চিন্তা করুন।

তাদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত তিনটি প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে?বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলার সাপমারাঝিরি মার্মাদের পৈতৃক ভিটা থেকে উচ্ছেদ করে রাবার বাগান করার লক্ষ্যে আক্রমন চালানো হয়। বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, ‘পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং রাবার বাগান মালিকদের আদিবাসীদের তাদের ভূমি হতে উৎখাতের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন’ (সূত্রঃ এপ্রিল ২৮, ২০১৪ ডেইলি স্টার)।দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার খালিপপুর গ্রামের চারজন সাঁওতাল সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হন। আদিবাসীদের একজন জানিয়েছেন সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করেছ, কিন্তু আমরা এখন জামিনে মুক্ত। এখন তোমাদের দেখে নেব।’ পুলিশের উপস্থিতিও তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে (সূত্রঃ জুন ১৩, ২০১৪ ডেইলি ষ্টার)।সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সিএইচটি কমিশনের কো চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ ও প্রশাসন তাদের (আদিবাসীদের) নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে’ (সূত্রঃ জুলাই ৯, ২০১৪ প্রথম আলো)।খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙা উপজেলার তাইন্দ্যং এলাকায় ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা এবং রিনি চাকমাকে গুলি করে আহত করে। সন্ত্রাসীদের একজন মোহম্মদ রিপন (২৩) কে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

অতীতের ঘটনা থেকে তারা বিশ্বাস করে যে, অপরাধীদের কিছুই হবে না (সূত্রঃ জুলাই ২৫, ২০১৪ ডেইলি স্টার)।তিমির বরন চাকমা জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) একজন সদস্য। তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে মাটিরাঙায় বেড়াতে গেছিলেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হন। আটকের পর তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এবং আলামত নষ্ট করার জন্য বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে তড়িঘড়ি তাকে দাহ করা হয়। দাহ করার আগে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও অনুষ্ঠিত করা হয়নি (সূত্রঃ আগস্ট ১২, ২০১৪ খ্রি; প্রথম আলো)।২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙাতে কামালউদ্দিন নামে একজন মোটরসাইকেল চালককে অপহরণ করা হয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে ‘অপহৃত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা এবং উদ্ধার করার জন্য আদিবাসী গ্রামগুলোর নেতাদের স্থানীয় বর্ডার গার্ড অফ বাংলাদেশ ক্যাম্পে যেতে বলা হয়। অনেক বাঙালিও বিজিবি ক্যাম্পে চলে যায়।

এরপর বিজিবি সদস্য, পুলিশ, বাঙালি ও আদিবাসী মিলে অপহৃত মোহাম্মদ কামালকে খোঁজা শুরু হয়। অনেকক্ষণ খুঁজেও কামালকে পাওয়া যায়নি। এতে বাঙালিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং তাদের সঙ্গে থাকা আদিবাসীদের পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে মারধর করে’ (সূত্রঃ ৫ আগস্ট, ২০১৩ প্রথম আলো)।গত ২৯ সেপ্টেম্বর সাড়া জাগানো রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে সাম্প্রদায়িকতার যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটির তিন বছর পূর্তি দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষোভের সাথে স্মরণ করা হয়েছে। রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দরা জানিয়েছেন, ‘হামলার সঙ্গে জড়িত ২০ জনের একটা তালিকা আমরা পুলিশকে দিয়েছিলাম, কিন্তু তাদের আসামি করা হয়নি। যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের আমরা চিনি না। এখন আদালতে কার বিরুদ্ধে আমরা সাক্ষ্য দেব? এতে আমাদের শত্রু আরও বেড়ে যাবে।’ধর্মীয় সংখ্যালঘু আদিবাসীদের অতীতের অভিজ্ঞতা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক, কষ্টদায়ক।

উত্তরবঙ্গের নওগাঁতে বহুল আলোচিত হত্যাকা- আলফ্রেড সরেন হত্যাকা-ের মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরেই পুলিশ অবস্থান করছিলো; কিন্তু তাদের সংবাদ দেয়ার পরও পুলিশ সময় মতো উপস্থিত হতে পারেনি। মধুপুরের চলেশ রিছিলকে সেনাবাহিনীর লোকজন কর্তৃকই নিহত হয়েছেন। পাহাড়িদের কণ্ঠস্বর কল্পনা চাকমার অন্তর্ধানে আদিবাসীরা সোজাসুজিভাবে স্থানীয় পুলিশ-সেনাবাহিনীর দিকেও অঙ্গুলি তুলে ধরেছেন। আদিবাসীরা পুলিশ, বিজিবি, আনসার কিংবা কোনো বাহিনীকেই নিরাপদ মনে করতে পারেনি; বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনি। পারিবারিক, সামাজিক কিংবা সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা সৃষ্টি হলেও স্থানীয় প্রশাসনের দরজায় যেতে পারতপক্ষে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। আদিবাসী জনসাধারণের হৃদয়ে এই বিশ্বাস গ্রোথিত হয়েছে যে, নীরব থেকে যতটুকু শান্তিতে থাকা যায়, স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করলে দু’দিক থেকে ঝামেলায়_ শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হবে। বাড়িঘর দখল, নির্যাতন ও হুমকির কারণে গত ১০ বছরে উত্তরবঙ্গের কমপক্ষে ৫০০ (পাঁচশত) আদিবাসী পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, আমার দেশের ২৭ শতাংশ মানুষ বলতে পারেনি মানবাধিকার কীভাবে রক্ষা করা যায়। ৪০ শতাংশ বলেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ এবং ১৭ শতাংশ বলেছেন সংবিধানের মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষা করা যায়। ১৭ শতাংশ বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে ‘চ্যাম্পিয়ান অফ দ্য আর্থ’ পুরস্কার গ্রহণকালে বলেছিলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমার দেশের মানুষ শিখেছে, কীভাবে বাঁচতে হবে, কীভাবে লড়তে হবে। আর আমরা তা করছি নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করে।’ সত্যিকার অর্থে দুর্যোগ হয়ে থাকে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট হয়েও। আদিবাসীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের রক্ষা করতে সমর্থ হলেও; কৃত্রিম দুর্যোগ থেকে বাঁচতে পারছেন না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা আদিবাসীদের সহায়-সম্পদ, জায়গা-জমি; বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, দেশত্যাগ, ধর্ষণ এবং শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে কৃত্রিম দুর্যোগ কোনো অংশেই কম নয়।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জরিপে দেখা যায়, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পঞ্চগড়, রংপুর, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁও জেলার দুই হাজার ৪৩৫ টি আদিবাসী পরিবার ভূমি হারিয়েছে। এতে আদিবাসী সম্প্রদায় ৩ হাজার ৮২৭ দশমিক ২৮ একর জমি হারিয়েছে। বাড়িঘর থেকে শুরু করে শ্মশান, কবরস্থান, পূজাম-প, ধর্মীয় স্থানও রক্ষা হচ্ছে না। ৫৪৯টি পরিবারের এক হাজার ১৯৯ একর জমি জাল দলিলের মাধ্যমে দখল করা হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ১৮৫ দশমিক ৭৬ একর জমি দখল নিয়েছে বন বিভাগ। এতে ৫২১টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম, বটতলী, ঈদলপুর, কান্তাপাশা, আগলপুর, বাগানপাড়া, দমদমা, তেলীবাড়ি, চৌদুয়ার, মুরারীপুর, আতাহার, সাঁকুড়া, চাম্পাতলা, ছাতনিপাড়া, গনশাপাড়া, বাবুলডাইং, হুজরাপুর গ্রামের শতাধিক আদিবাসী সম্প্রতি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ভূমিদস্যুদের ভয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নের আদিবাসী অধ্যুষিত বৈলঠা, চট্টিগ্রাম ও বাবুডাইংয়ের আদিবাসী পল্লীর সাতটি পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দেশের আদিবাসীদের রাজনৈতিক দলসমূহের কৃত্রিম দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে বাঁচার ব্যবস্থা করে দিন।

আদিবাসীরা কৃত্রিম দুর্যোগ থেকে বাঁচার কৌশল শিখতে পারেনি; কীভাবে লড়তে হবে তা জানেন না। অহিংস আন্দোলনের পথিকৃত ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘একটা দেশ কতটা সভ্য তা দেখতে হলে সে দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থার দিকে চোখ তুলে দেখ। যে দেশের সংখ্যালঘুরা যত বেশি অধিকার ভোগ করে, জানবে তারা তত সভ্য, তারা তত মানবিক।’

f

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.