ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চান উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ

সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৫

56ঢাকা: বর্তমানে আইন বিভাগ অর্থাৎ জাতীয় সংসদ একদলীয় হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় এ অবস্থা আরো খারাপ হবে।’

রোববার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার সঞ্চালনায় এতে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন, ড. শওকত আলী, অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। আরো উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা।

এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। আমার উদ্দেশ্যে হলো জনগণের ক্ষমতায়ন ও গণতন্ত্রকে টেকশই করা। আমরা এটি পারবো না, আমাদের সেই ক্ষমতা নেই। রাজনীতিবিদদেরই এ কাজটি করতে হবে। আমরা চাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। দেশের গণতন্ত্র সুসংহত ও পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের জন্য শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। আমরা অতীতের নির্বাচন দেখেছি। সেখানে সংঘাত হয়েছে। এজন্য আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। দেশের আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন যদি সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। কিন্তু দুঃখজনক এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন দলীয়করণ হচ্ছে। উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ এগুলো নিয়েই কাজ করছে।’

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা না থাকলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। আমরা যতই কথা বলি না কেন, তাতে কাজ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব, তার সর্বশেষ প্রমাণ শ্রীলঙ্কা। তারা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য ঐক্যমত প্রয়োজন। ভারতে রাজনৈতিক বিভাজন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে প্রকট। কিন্তু জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে যায়।’

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘অতিকেন্দ্রীক অতিরিক্ত ক্ষমতা, এককেন্দ্রীক সমতা রাষ্ট্র নয়, সগঠন পরিবারিক ক্ষেত্রেও ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ক্ষমতা মানুষকে হীতাহিত জ্ঞানশূন্য করে। ক্ষমতার প্রতি অতি অনুরাগ মাদকতা ও উন্মাদনায় কিছু কিছু মানুষ পাগল হয়ে যায়।’

প্রশাসনকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সচিব কখনো মন্ত্রীর কর্তৃত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে না। সচিব যদি রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যায়, তাহলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে মন্ত্রী কতটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন, সেটাও বিবেচ্য বিষয়। নাকি সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।’

ড. তোফায়েল তার সাত দফা সুপারিশমালায় তিনি বলেন, ‘প্রতিটি নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত কার্যক্ষমতা, তাদেরকে চর্চা করতে দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনোরূপ বাধা বা হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হতে পারে, কিন্তু দলীয় বিবেচনায় পুরস্কার, শাস্তি, অর্থায়ন হতে পারে না। পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশের জেলা পরিষদগুলোকে যথা শিগগিরই সম্ভব নির্বাচিত প্রতিনিধির শাসনের আওতায় আনতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পিরষদ পর্যায়ে সরকারি দপ্তর, জনবল এবং অর্থ সম্পদ হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে ত্বরানিত করতে হবে।’

ড. শওকত আলী বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় সরকার নিয়ে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। স্থানীয় সরকারকে ফলপ্রসূ করতে হলে প্রথমেই কেন্দ্র থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র। এর কোনো প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্য নেই। একক রাষ্ট্রে ক্ষমতার পুরোপুরি বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব নয়। এটা কেন্দ্রের হাতেই থাকবে।’

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থকে যদি কেন্দ্র থেকে বের করা না যায়, স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রেীকরণ করা সম্ভব নয়। এমপিরা অসাংবিধানিকভাবে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে। এটা বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিকশিত করতে হলে এর আর্থিক স্বাধীনতা অবশ্যই প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দেশের বিদ্যমান সম্পদেরও বিকেন্দ্রীয়করণ করার প্রয়োজনিয়তা রয়েছে। এর জন্য একটি স্বাধীন আর্থিক কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।’

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার বলেন, ‘আমলারা কোনোদিনই কোনোভাবেই চায় না ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হোক। বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ার জন্য আমলারাই দায়ী।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাগজপত্রে অনেক কাজ দেয়া হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা বা অর্থ কোনোটাই দেয়া হয়নি। আগে আমরা জলমহল, হাটবাজার থেকে কর ধার্য করে টাকা পেতাম। এডিপি থেকেও ভাগ পেতাম, সেই ক্ষমতা এখন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের অবস্থা ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদারের মতো। জনগণ ইতোমধ্যেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে এনেছে। এখন যদি স্থানীয় প্রতিনিধদের কাছ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াবে আপনারাই বলেন? ইউএনও যিনি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার কথা, তিনি ব্যস্ত থাকেন ডিসির মনোরঞ্জনে। যে সরকারই আসে, সে সরকারই আমলাদের সঙ্গে হাত মেলায়। কিন্তু সরকার এ সত্যটা বুঝতে চায় না, আমলারা দেশ চালায় না। দেশ চালায় গার্মেন্টস শ্রমিক ও বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকরা।’

২০-সেপ্টেম্বর-২০১৫

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.