সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছতে চাইছে আইএস

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৫

lll১৯৯৯ সালে আইএসের যাত্রা শুরু হলেও এর ভয়াবহ আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০০৬ সালের পর থেকে। সাদ্দাম হোসেনের উৎখাতের পরে প্রত্যন্ত  এলাকায় বিদেশিদের বসিয়ে দেওয়া ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। তেমনি সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের হাতছাড়া হওয়া এলাকাগুলোতেও শূন্য হয়ে পড়ে প্রশাসন। লিবিয়াতেও মুয়াম্মার গাদ্দাফির মর্মান্তিক পরিণতির পর ক্ষমতায় বসা সরকার কাঠামো হয়ে পড়ে অত্যন্ত দুর্বল। এই সুযোগেই মূলত লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নেয় চরমপন্থী গোষ্ঠী আইএস, যাকে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত বলা হয়। ২০১৪ সালের ২৯ জুন নিজেদের মুসলিম বিশ্বের খলিফা ঘোষণা করে ইসলামিক স্টেট নাম গ্রহণ করে তারা। এই গোষ্ঠীর কবজায় এখন ১০ মিলিয়ন অধিবাসীর এক বিশাল ভূখণ্ড।

আইএস ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে কিংবা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য কত বড় হুমকি হয়ে উঠেছে, সেটি আমার আলোচনার বিষয় নয়। ইরাক ও সিরিয়া তথা মেসোপটেমীয় সভ্যতা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে মহাগুরুত্বপূর্ণ। আর গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার স্মৃতিচিহ্নগুলো মোটামুটিভাবে বলা যায় নিশ্চিহ্ন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা চালিয়েছে অভিশপ্ত চরমপন্থী গ্রুপ আইএস। এই অপকর্ম এখনো চলমান। প্রত্নতত্ত্বের সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমার উদ্বেগ সেখানেই।

গত দুই বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা ও মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী ধ্বংস ও লুটের মহোৎসব চালাচ্ছে চরমপন্থী গ্রুপ আইএস।

২০১৪ সালের জুন থেকে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮টি বড় বড় ঐতিহাসিক স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস করেছে তারা। যদিও ১৯৫৭, ১৯৫৮ ও ১৯৬৭ সালের লিবিয়া, সিরিয়া ও ইরাকের স্বশস্ত্র সংঘাতের সময়ও হেগ কনভেনশনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে এসব স্থাপনা ও প্রত্নবস্তুর সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তবে এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সিরিয়া-ইরাক জুড়ে চলমান গৃহযুদ্ধে ২৯০টি ঐতিহাসিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৪টি স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, ১০৪টি আংশিক ধ্বংস, ৮৫টি হালকা ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৭৭টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে বহু প্রাচীন বাজার, ঐতিহাসিক মসজিদ, সমাধি ও ক্রুসেডারদের স্মৃতিচিহ্ন। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত অন্তত ছয়টি স্থান রয়েছে আইএসের ব্যাপক ধ্বংসের তালিকায়। এগুলোর মধ্যে আলেপ্পোর পুরোনো শহর (সাত হাজার বছর আগে যে নগরীর গোড়াপত্তন হয়), বসরা, দামেস্ক, উত্তর সিরিয়ার মৃত শহরগুলো, ক্র্যাক দেস চ্যাভালিয়ার্স দুর্গ ও পালমিরার গ্র্যাকো-রোমান স্থাপনা।lllll

জুন ২০১৪ সালে আইএস গুঁড়িয়ে দেয় ফাতি আল কায়েনের সমাধি। ১৬ জুন মসুলে সব চার্চ ধ্বংস করে আইএস। ২৫ জুলাই ১৩ শতকের ইমাম আইন-আল-দীনের সমাধি ধ্বংস করে। ২০১৪ সালের ২৬ জুলাই ভার্জিন ম্যারি চার্চ, ২১ সেপ্টেম্বর আর্মেনীয় গণহত্যার স্মৃতিবাহী চার্চ, ২৪ সেপ্টেম্বর সপ্তম শতকের গ্রিন চার্চ (যেটি অ্যাসিরীয় সভ্যতার স্মৃতিধারণ করে) ধ্বংস করে আইএস।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইএস মসুলে অবস্থিত সপ্তম শতকের তাহিরা চার্চ জ্বালিয়ে দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি আইএস প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মসুল শহরের জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন ভাস্কর্য ও মূর্তি ধ্বংস করছে আইএস সদস্যরা। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীর অ্যাসিরীয় সভ্যতার সুরক্ষা দেবতা ডানাযুক্ত এক ষাঁড়ের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয় তারা।

৬ মার্চ নিমরুদে হামলা চালায় এই চরমপন্থীরা। তারা খ্রিস্টপূর্ব ৮৮৩-৮৫৯ সাল পর্যন্ত শাসন করা সম্রাট দ্বিতীয় আসুরবানিপালের রাজপ্রাসাদসহ অ্যাসিরীয় সভ্যতার যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করে। দজলা নদীর তীরে এই শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতকে মসুল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে গড়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দে বিশ্বের প্রথম সাম্রাজ্য নিও অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল নিমরুদ। এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন ঐতিহাসিক স্থান। যুদ্ধ কৌশল, উন্নত সমরাস্ত্র এবং দক্ষ ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কারণে অল্প সময়েই বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল অ্যাসিরীয়রা। মসুল আর নিমরুদের পর তারা বেছে নেয় বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হাত্রা নগরী। প্রাচীন রোমানদের হামলা ঠেকাতে ২২০০ বছর আগে পার্থিয়ান যুগে সুরক্ষিত এ দুর্গ নগরীটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের সুউচ্চ দেয়ালঘেরা প্রাচীন এ নগরী এতটাই সুরক্ষিত ছিল যে রোমান যোদ্ধারাও তা ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। এসব স্থাপনা কোনোটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, আবার কোনোটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। আইএস কিছু স্থাপনা আগুনে পুড়িয়েও দিয়েছে। ৯ মার্চ ইরাক সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে দশম শতকের সেন্ট মার্কারকাস চার্চ ধ্বংস করেছে আইএস।

সিরিয়ার রাক্কা শহরে খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে স্থাপিত অ্যাসিরীয় প্রবেশদ্বারের সিংহমূর্তি ভেঙে ফেলে তারা। এখানে আরো একটি সিংহমূর্তিও ধ্বংস করা হয়। দুটি মূর্তিই আর্সলানতাশ প্রত্নস্থানে অবস্থিত। পরে আইএস প্রকাশিত ম্যাগাজিন দাবিক-এ এসব ধ্বংসের বর্ণনা ছাপা হয়।

মে মাসে আইএস গ্রুপ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান পালমিরার দখল নেওয়ার পর থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকরা আশঙ্কা করছিলেন, এটিও হয়তো অন্যান্য প্রত্নস্থানের মতোই পরিণতি বরণ করবে। তাদের এই আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়, তা জানা গেল মাত্র কয়েক সপ্তাহেই। ২৭ মে ২০১৫-তে আইএসের পক্ষ থেকে ৮৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছাড়া হয়, যাতে পালমিরা নগরীর স্বাভাবিক চিত্রই দেখা যায়। বিশেষ করে রোমান থিয়েটার এবং বেল মন্দিরের। তবে ২৭ জুন পালমিরার তিন মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট, ১৫ টন ওজনের প্রাচীন সিংহমূর্তি আল লাত ধ্বংস করে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এটি পালমিরার মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল। ২৩ আগস্ট তারা ধ্বংস করে প্রথম শতকের বালশামিন মন্দির। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস ৩০ আগস্ট জানায়, বেল মন্দিরটির বড় অংশই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে জাতিসংঘের স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞরা, চিত্র বিশ্লেষণ করে জানান, মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবেই ধ্বংস করা হয়েছে। এর আগে আগস্টের শুরুতে তারা চরম নৃশংসতা দেখায় শহরটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা ৮২ বছর বয়সী প্রত্নতত্ত্ববিদ খালেদ আল আসাদকে হত্যা করে। গলা কেটে হত্যার পর তাঁর মরদেহ প্রাচীন এক স্তম্ভের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। এই পালমিরা মূলত একটি মরূদ্যান। দুই হাজারেরও বেশি সময় ধরে অনন্য সব মন্দির আর রাস্তাঘাট নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এটি। ধ্বংসের আগে অপূর্ব সব মূর্তি, হাজার খানেক স্তম্ভ আর পাঁচ শতাধিক সমাধি নিয়ে কালের এক অনন্য সাক্ষী ছিল পালমিরা।

ধ্বংসের পাশাপাশি তারা বেপরোয়া লুটপাট চালিয়েছে। তহবিল জোগাতে চোরাকারবারিদের কাছে এসব মূল্যবান প্রত্নবস্তু বিক্রিও করছে এই অসহিষ্ণু সম্প্রদায় আইএস।

ইউনেসকো প্রধান ইরিনা বোকোভা এরই মধ্যে আইএসের এই ধ্বংস কার্যক্রমকে যুদ্ধাপরাধের শামিল অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ইরাকের ১০ হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার মধ্যে এক পঞ্চমাংশ এরই মধ্যে লুট হয়েছে। অন্যগুলোর কী অবস্থা জানা যায়নি। কোনো কোনো স্থাপনার এমন ক্ষতি হয়েছে যাতে ওই সব স্থাপনার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বই হারিয়ে গেছে। অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে অ্যাসিরীয় সম্রাটরা যেসব এলাকায় রাজধানী গড়েছিলেন, যেখানে গ্র্যাকো রোমান সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল এবং মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পবিত্র স্থানগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল মানবসভ্যতার অনন্য নিদর্শন হিসেবে। মানবসভ্যতায় অনেক ক্ষতির রিপ্লেস হতে পারে। তবে প্রাচীন মানবসভ্যতার এই অনন্য নিদর্শন ধ্বংস অপূরণীয় ক্ষতি। কারণ এর কোনো ক্ষতিপূরণ চলে না। মানব সংস্কৃতির শেকড়ের পরিচয় মুছে দেওয়ার এই চেষ্টা সভ্যতার জন্য অভিশাপ। নিঃসন্দেহে এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।

লেখক : ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.