নিয়ন্ত্রণহীন গণপরিবহন

সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫
bas

রাজধানীর গণপরিবহন সার্ভিসের বেহাল অবস্থা। এতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সিটিং সার্ভিস, বিরতিহীন ও গেটলক সার্ভিসের নামে আদায় করা হয় অতিরিক্ত ভাড়া। পরিবহন সংকটে বাদুড়ঝোলা হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছেন যাত্রীরা। বন্ধ হয়ে গেছে এসি বাস সার্ভিস। কাউন্টার নেই তবুও কাউন্টার বাসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।

উঠে গেছে টিকিট পদ্ধতি। লক্কড়-ঝক্কড় বাস রঙ দিয়ে চালানো হচ্ছে রাজধানীজুড়ে। ময়লা, আবর্জনা, দুর্গন্ধ মিলিয়ে বাসের ভেতরের পরিবেশ একেবারেই অস্বাস্থ্যকর। অপরদিকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো। যাত্রীদের কাছ থেকে খেয়াল-খুশিমতো ভাড়া আদায় করছে তারা। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না চালকরা। মিটার ব্যবহার তো করেনই না উপরন্তু নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে পাঁচ গুণ ক্ষেত্রবিশেষে দশ গুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের কাছ থেকে। তাই রাজধানীজুড়ে ভাঙচুরা সড়ক, জলাবদ্ধতা ও বেহাল পরিবহন সার্ভিসের কারণে চরম দুর্ভোগে আছে নগরবাসী।গণপরিবহন ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় এর কোন সুযোগ-সুবিধা নেই ঢাকায়।

যা আছে তাতেও নেই কোন নিয়ন্ত্রণ। ইচ্ছেমতো যেদিক দিয়ে ইচ্ছে চলাচল করছে। ভাড়া আদায়ের কোন নিয়ম নেই। রাজধানীতে চলাচলরত লেগুনা, বাস, মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সকল গণপরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয় ইচ্ছেমতো। একই রুটের বিভিন্ন বাস-মিনিবাস ভাড়া নেয়া হয় বিভিন্ন রকম। বিরতিহীন, গেটলক, সিটিং সার্ভিস ও কাউন্টার সার্ভিসসহ নানা নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। মাঝে মাঝে মধ্যে লোকাল বাসেও সিটিং সার্ভিসের নামে যাত্রীদের কাছে দ্বিগুণ ও তিনগুণ ভাড়া আদায় করে বাস মালিকরা।

এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। অথচ এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অপরদিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। যাত্রীদের কাছ থেকে খেয়াল-খুশিমতো ভাড়া আদায় করে চালকরা। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না তারা। মিটার ব্যবহার তো করেই না উপরন্তু নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে পাঁচ গুণ ক্ষেত্রবিশেষে দশগুণ পর্যন্ত ভাড়া অতিরিক্ত আদায় করা হয় বলে জানান যাত্রীরা।এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. সারওয়ার জাহান সংবাদকে বলেন, রাজধানীর গণপরিবহনে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছে সরকার। একটি মেগাসিটি যে মানের গণপরিবহন থাকার কথা তার কিছুই নেই।

একদিকে যানজটের নগরী অপরদিকে পরিবহন সার্ভিস চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। যে যেখান দিয়ে পারছে চালিয়ে যাচ্ছে। রিকশা, বাস সকল পরিবহনে আদায় করা হয় ইচ্ছেমতো। এখানে বলা যায় পরিবহন সার্ভিস চলছে বাধাহীনভাবে। বিআরটিএ কিছু বলেছ না। ট্রাফিক ব্যবস্থা দুর্বল। তবে পরিকল্পিত নগরায়ণ করতে হলে গণপরিবহন সার্ভিসকে করতে হবে আধুনিক। এখানে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিড (বিআরটি) ও এমআরটি বাস্তবায়ন এগিয়ে দিতে হবে। এছাড়া পরিবহন সার্ভিসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কঠোরভাবে।জানা গেছে, সরকার গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলেই প্রতিবারেই বৃদ্ধি করা হয় পরিবহন সার্ভিসের ভাড়া। তবে সরকার নির্ধারিত এই ভাড়া মানে না অনেক পরিবহন মালিকরা। ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে তারা। বিশেষ করে রাজধানীতে গণপরিবহন সার্ভিস চলছে পুরো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে।

রাজধানীতে চলাচলরত লেগুনা, বাস, মিনিবাস ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ কোন গণপরিবহন থাকে না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট। তাই ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হয়। দেখা যান একই রুটে একাধিক পরিবহন বিভিন্ন ভাড়া আদায় করে। যেমন, যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর এই রুটে একাধিক পরিবহন চলাচল করে। এরমধ্যে দেখা যায় যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেটের দূরুত্ব ৯ কিলোমিটার। কিন্তু ভাড়া একেকটি পরিবহনে ভাড়া আদায় করা বিভিন্ন রকমে।

যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটে চলাচলকারী ২১ নাম্বার বাস (সাবেক ৮ নাম্বার) যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট ভাড়া নেয় ১৫ টাকা। তবে যাত্রাবাড়ী-মিরপুর রুটে চলাচলকারী শিকড় পরিবহন নেয় ২৮ টাকা। একইভাবে যাত্রাবাড়ী থেকে মতিঝিল, পুরানা পল্টন, গুলিস্তানের ভাড়া সাধারণত ৫ টাকা। কিন্তু ট্রান্স সিলভা পরিবহনে নেয়া হয় ১০ টাকা, শিকড় পরিবহনে ৬ টাকা, বেস্টওয়ে পরিবহনে ১৫ টাকা ও গ্রামীণ বাংলা পরিবহনে ১০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হয়। একই অবস্থা সদরঘাট-মিরপুর রুটে এসব বাসগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে।

এরমধ্যে বিরতিহীন, গেটলক, সিটিং সার্ভিসসহ বিভিন্ন নামে যাত্রীদের কাছ থেকে এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। তবে এসব নাম ব্যবহার করে যেসব পরিবহন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে তা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ বলে বিআরটিএ’র সূত্র জানায়।এ ব্যাপারে বিআরটিএ’র সাবেক পরিচালক সাইফুল হক সংবাদকে বলেন, পরিবহন নির্ধারণের জন্য সরকারের দুটি কমিটি আছে। এরমধ্যে একটি হলো সাব-কমিটি বা ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি। অপরটি মূল কমিটি। ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি পরিবহনের যাবতীয় আয়-ব্যয় বিশ্লেষণ করে ভাড়া বৃদ্ধি একটি খসড়া প্রস্তাবনা মূল কমিটির কাছে পেশ করে।

এরপর মূল কমিটি তা চূড়ান্ত করে। কিন্তু রাজধানীর পরিবহনগুলো ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন প্রকার বিরতিহীন, গেটলক, সিটিং সার্ভিস, কাউন্টার সার্ভিস নাম উল্লেখ নেই। এসব নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি।এদিকে রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা। যাত্রীদের কাছ থেকে খেয়াল-খুশিমতো ভাড়া আদায় করছে তারা। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না চালকরা। মিটার ব্যবহার তো করেনই না উপরন্তু নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে পাঁচ গুণ ক্ষেত্রবিশেষে দশগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছেন যাত্রীদের কাছ থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় চলছে অবৈধ ভাড়া আদায়।

ফলে সিএনজি যাত্রীরা প্রতিদিন প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ড্রাইভারদের খামখেয়ালিপনার মুখোমুখি হয়ে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করছেন লাখো যাত্রী।জানা গেছে, রাজধানীতে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার সিএনজি চলাচল করছে। বর্তমানে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটার ২৫ টাকা। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ৭ টাকা ৬৪ পয়সা। এছাড়া ওয়েটিং চার্জ ১ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারিত রয়েছে। যদিও সরকার নির্ধারিত এ ভাড়া মানে না কোন অটোরিকশা চালকই। বরং তারা মিটারের পরিবর্তে চুক্তিতে যাতায়াত করেন। পাশাপাশি মালিকদের জমা ৬০০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও নেয়া হয় ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় চলছে অবৈধ ভাড়া আদায়। ফলে সিএনজি যাত্রীরা প্রতিদিন প্রতারণার শিকার হয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ড্রাইভারদের খামখেয়ালিপনার মুখোমুখি হয়ে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করছে বলে যাত্রীরা জানান।পাভেল নামের যাত্রী বলেন, রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশার কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে আছে সাধারণ যাত্রীরা। মিটার ব্যবহার তো করেই না। উল্টো যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যেমন যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তানের ভাড়া চায় ২০০ টাকা।

একইভাবে গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটের ভাড়া নেয় ২৫০-৩০০ টাকা। গাবতলী ভাড়া নেয় ৪০০-৫০০ টাকা। এছাড়া যেখানে ইচ্ছে যায়। যেখানে ইচ্ছে যায় না। তাদের কাছে পুরোপুরি জিম্মি সাধারণ মানুষ। আমাদের দেখার কি কেউ নেই। পুলিশকে বলেও কোন লাভ হয় না। অথচ বিআরটিএ নিয়ম অনুযায়ী একজন যাত্রীকে তার পছন্দমতো জায়গায় নির্দিষ্ট মিটারে নিয়ে যেতে একজন ড্রাইভার বাধ্য। ড্রাইভার কোনভাবেই তাকে না বলতে পারবে না। মিটার ছাড়া কোন অবস্থায় চুক্তিতে যাত্রী বহন করতে পারবে না। কিন্তু এখন সিএনজি চালকরা সেই নিয়মের ধারে কাছেও নেই। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে সিএনজির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার কথা। মালিকরা এমন শর্তেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। কিন্তু গাড়ি রাস্তায় নামার পর তারা মুহূর্তেই শর্তের কথা ভুলে যান। বিআরটিএ থেকেও এসব দেখার কেউ নেই জানান তিনি।

এদিকে কাওসার নামের এই অটোরিকশা চালক সংবাদকে বলেন, চালকদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি সবাই বলে। কিন্তু সিএনজি চালকরা যে মালিকদের কাছে জিম্মি এটা কেউ বলে না। কারণ প্রতিদিন গাড়ির জন্য ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা খরচ আছে। এর মধ্যে মালিকের জমা দেয়া লাগে ১০০০ টাকা। পথে সারাদিন চা, নাস্তা, সিগারেট খরচ হয় গড়ে ২০০ টাকা, গ্যাস খরচ হয় গড়ে ৩০০ টাকা, বিভিন্ন অজুহাতে পুলিশ নেয় নূ্যনতম ১০০ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় পার্কিং বা লাইনম্যানদের গড়ে ৫০ টাকা দেয়া লাগে, গাড়ি ধোয়ার জন্য দৈনিক ৩০ টাকা, গ্যারেজে গার্ডকে দৈনিক ২০ টাকা তাদের প্রাত্যহিক খরচ। ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা খরচ করার পর আমাদের আয় করতে হয়। তার ওপরে সারা শহরে যানজট লেগেই থাকে। সকালে বের হয়ে দু’চারটা ট্রিপ মারতেই বেলা পড়ে যায়। দিনশেষে অনেক ক্ষেত্রে শূন্য হাতে বাসায় ফিরতে হয়। এছাড়া গাড়ির কাজ-কামও মালিকরা ঠিকমতো করেন না।

ফলে অচল কিংবা ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়েও তাদের বের হতে হয়। তবে অটোরিকশার ভাড়া বাড়িয়ে মালিকদের জমা কমানো হয় তাহলে মিটারে অটোরিকশা চালানো সম্ভব বলে জানান তিনি।এ ব্যাপারে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক সংবাদকে বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকদের বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া ও মিটার ব্যবহার না করার অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যাত্রীদের কাছ থেকে কোন সমর্থন পাওয়া যায় না।

যাত্রীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে মিটারে যাচ্ছেন। এরপর যদি কোন যাত্রীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চালকদের জরিমানা ও অটোরিকশা ডাম্পিং করা হয়। এছাড়া মালিকদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জমা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে গ্যারেজ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চালকদের কাছ থেকে মালিকদের তেমন অভিযোগ পাওয়া যায় না। তবে কঠোরতার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া বাড়ানো একটি প্রস্তাবনা আমরা পেয়েছি। তা ভাড়া নির্ণয় কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কমিটি যা সুপারিশ করবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

শনিবার, ০৫-সেপ্টেম্বর-২০১৫

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.