ভোঁতা হয়ে এসেছে সংবেদনশীলতা । রওশন আরা লীনা

সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৫

nilaআহত পথশিশুকে পাশকাটিয়ে যে লোকটি এই মাত্র চিত্রশালায় ঢুকলো

ঝোলানো ফ্রেমে বিবিসি মুদ্রিত একটি শিশুর লাশের দিকে – অপলক তাকিয়েতার চোখে জল জমতে দেখেছি।সঞ্জীব পুরোহিত ( এই সব শিল্পশিল্প খেলা )’ ঢাকা শহরে আজ একজন অজ্ঞাতনামা তরুনীর সাতকুটরো লাশ পাওয়া গেছে ‘  এবং আকাশ আজ একি রকম নীল ও বাস্তবিক  বিকেলের রোদ্দুর তার সোনারঙ নিয়ে গলেগলে শেষ বেলায় মিশেগেছে সোমেশ্বরী তে । সন্ধ্যার বাতাস আজো একই রকম ভাবে বয়ে চলেছে । আমের মূকুল, ভাট আর  মুচকুন্দর সুতীব্র ঘ্রান।

আর তারসঙ্গে উতলা কোকিলের ডাক। খবরে প্রকাশ মেয়েটির মুখ পুড়িয়ে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিলো। এবং বসন্ত এখনো এই দেশে বিরাজ মান। যেহেতু হিন্দিগান বাজিয়ে রাতভর হুল্লোড় করে আমরা এখনো বাংলা নববর্ষকে বরণ করিনি।  মেয়েটি তার সম্ভ্রম, নিরাপত্তা ও জীবন হারিয়েছে। আমরা হারিয়েছি তারচেয়েও বড় ও অমূল্য এক সম্পদ আমাদের বোধ। আমাদের সংবেদনশীলতা। আমাদের সহমর্মিতা । যদিও এই বসন্তেই রক্তে রাঙা রাজপথ দেখে আমরা গেয়েছি আজও গাই ‘ আমার ভায়ের রক্তে রাঙনো ‘ কিন্তু এই বসন্তেই আমরা হত্যাকরেছি আমাদের বিবেক, আমাদের মনুষ্যত্ব আমাদের স্বাধীনতা, খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।

২৬ ফেব্রুয়ারী বইমেলা প্রাঙ্গনে মুক্তমনা সাহসী লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ  রায় এর ওপর  হওয়া হামলার পর স্বভবতই চোখ রাখছিলাম সংবাদের আশায় নিউজ চ্যানেল গুলোতে । হঠাৎ দুই  তিনটি চ্যানেলে  দেখলাম টেলিভিশনের সামনে কিছু ছাত্র-ছাত্রী বক্তব্য রাখছেন। তারা ঘটনার সময় আশেপাশেই ছিলেন। কিন্তু ছুটেযেতে  পারেননি। কারন পুলিশী হাঙ্গামায় পড়তে হতে পারে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো  যে, আমি একুশ শতকে বসবাস করছি এবং যারা সাক্ষাৎকারটি দিলেন তারাও,  এ  শতকেই বাস করেন। আহমেদ ছফা একবার বলেছিলেন ‘ আমাদের দেশের বুড়োরা ঠিকঠাক মতো বুড়োহতেও জানেনা। যতোই বুড়োহয় ততোই তাদের  ভেতর বাঁদরের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে।

তেমনি অনেক তরুন কিশোরকে পেন্সিলের একটা খোচা দিলেই দেখতে পাই তার ভেতর দিয়ে অনর্গল বাঁদর স্বভাবের জীর্ণ বুড়ো বেরিয়ে আসছে। ‘ – আমার কাছে কথাটা সর্বাংশে সত্যি মনে হয়েছে নইলে -‘  বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা পুলিশে ছুঁলে ছঠত্রিশ ঘা ‘- এই মধ্যযুগীয় উচ্চারন তারা করেন কি করে ? আমরা সাবাই জনি অভিজিৎ এর মরদেহের পাশে দাড়িয়ে  তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা প্রানপন চিৎকার করেছিলেন সাহায্যের জন্য কেউ ছুটে যায়নি। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ পরে বিবৃতি দিয়েছেন স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া মনে করে তারা যাননি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ঠিক কতোটা জোরে চিৎকার করলে তবে তাদের কর্নকূহরে প্রবেশ করবে যে মানুষটির জীবন বিপন্ন ? এর আগে সাগর রুনি হত্যাকান্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি বেড রুমের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না।

তিন বছরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালত থেকে সময় নিয়েছেন তিন নং ২৭ বার নয়   ৩২ বার। প্রায় দেড় দশক আগের একটি পরিসংখ্যান ছিলো অনেকটা এই রকম বাঙলাদেশে  ২৩৫টি ধর্ষণ ,  ১৫০টি খুন,  ৯৭টি বাস দূর্ঘটনা,  ৮৩টি আত্যহত্মা, ১১২টি স্ত্রী হত্যা, ৬৫টি টি নৌকাডুবি  ৫০৫০টি  ডাকাতি। পুলিশ ১২কোটি, মাস্তানরা ১০ কোটি আমলারা ১৫ কোটি, ব্যাংক থেকে শিল্পপতিরা ১০৫ কোটি সেনাপতিরা ২২ কোটি মন্ত্রীরা ২৫ কোটি, রাজনীতিকরা  ২৭  কোটি, রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রাধান ও তার সহযোগীরা  ৩৫ কোটি  রাস্তার ভিখারীটা ১ টাকও না , রিকশা ওয়ালা ১ টাকা ও না।

এবং এই সময়েই বাংলাদেশে তীব্র থেকে তীব্র তর হয় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। নূর হোসেন প্রকাশ্যে পিঠে লিখে আত্নহুতি দেন ‘ স্বৈরাচার নিপাত যাক গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ আজ অন্ধ, বধির লোকটিও বলতে পারবেন দেশে এই সংখ্যা বেড়েছে বহুগুনে। হত্যার ধরনও বদলছে। পেট্রোল বোমা, চাপাতি আজ অনেক সহজ লভ্য অস্ত্র যেমন সহজ সুন্দর মারনাস্ত্র প্রাচীন যুগের গদা , তীর ধনুকের চেয়ে একটি পারমানবিক বোমা। কিন্তু যদিও ফেসুবক টুইটার ও প্রযুক্তির  নানা মাধ্যমে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ বেড়েছে। প্র্রযুক্তির উন্নততর উৎকর্ষ আমাদেরকে নিয়ে চলেছে উন্নততর সভ্যতার দিকে। যেখানে আমরা শাহবাগ সহ সারাদেশে পেয়েছি চিন্তাশীল প্রতিবাদী এক নতুন প্রজন্ম।

তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি জাতির সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়েগেছে। নইলে  বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এ সাক্ষাৎকার দেন কোন মুখে ? স্থানীয় ব্যবসাযী চা বিক্রেতা ও নানা জনের বক্তব্য শোনা হল, তারাও বললেন পুলিশী হয়রানির ভয়ে তারা  এগিয়ে যাননি। কিন্তু বিচিত্র বাস্তবতা হলো স্বয়ং পুলিশ ইন ইসপেক্টর ও তার স্ত্রী খুন হয়েছিলেন কিছু কাল আগে তাদের সন্তান ঐশীর হাতে। আর এই সব ঘটনা প্রমান করে শুধু নির্দিষ্ট একটি জনসমস্টি নয় জাতি হিসেবেই আমরা সকলে আজ অস্থির, উদ্ধতও অসহিষ্ণু। আমরা ডাকাত সন্দেহে বরোজন, কিম্বা দশজন মানুষকে পিটিয়ে মেরেফেলতে পারি।

রাজনীতির ঝান্ডা ওড়াতে রাজপথে চুলোচুলি করতে পারি। কিন্তু পাশেরবাড়ির অসহায় বৃদ্ধার খবর কেন? অনেক সময় নিজের বাবার নামই মনেকরতে পারিনা। ফেসবুকে ৪টা নাম লিখেদিলে নিজের বাবারটায় লাইক দিতে পারি।  আমাদের সামাজিক ও মানবিক মুল্যবোধ আমাদের সহনশীলতা এতটাই কমেছে যে, একই পরিবারে থেকেও আমরা আজ বসবাস করি বিছিন্ন দ্বীপের মতো। আমাদের ছেলেবেলায় বড়দের মুখে একটা মজার গল্প শুনতাম কলকাতার বাবুদের নিয়ে। যদিও পরবর্তীতে জেনেছি সবকথা সর্বাংশে ঠিকনয়। ভালোমন্দ সদা সর্বতএ  বিরাজমান ।

তবে ঐ বয়সে গল্পটা শুনে খুব ধাক্কা লাগতো বুকে। ‘ এপার বাঙলাথেকে কোনও একজন ব্যক্তি গিয়ে হাজির হযেছেন পশ্চিম বাংলার  এক আত্নীয়ের বাড়ি। যেহেতু দীর্ঘ পথশ্রমে তিনি ক্লান্ত।আশাকরছেন উপর্যুক্ত আতিথ্যের কিন্তু গৃহকর্তা তাকে সমাদরে ডেকে কুশলাদি জেনে বললেন দাদা পরেরবার কিন্তু অবশ্যই চা  খেয়ে  যাবেন’- অথবা আর ও একটি গল্প ‘খেয়ে এসেছেন না যেয়ে খাবেন ? আমাদের শিশুমনে এসব গল্প ঢুকিয়ে বড়রা নিশ্চয়ই তাদের অজন্তে সাবধান করে দিতেন মানবিকতা এই স্বার্থপরতা নয়। কিন্তু স্বার্থপরতা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু নয় সবরকম মানুষের সাংবাদিক জীবন যখন ছুটে গেছিলেন তাদের সাহায্যকরতে তখন অনেক পত্রিকায় লেখা হযেছে তার উচিৎ ছিলো আগে ছবি তোলা।

হ্যাঁ অবশ্যই উচিৎ ছিলো তাহলে আমরা পেয়েও  যতে পারতাম সেই দুর্ভিক্ষের ছবির মতো অসামান্য ছবি ( যেখানে কঙ্কালসর এক শিশু খাবারের আশায় হামাগুড়ি দিচ্ছে অদূরে অপেক্ষারত শকুন )যদিও সেই সাংবাদিক পরে আত্নহত্যা করেছিলেন। এযুগে আর তার দরকার পড়েনা। আমরা প্রতিদিন টিভি পর্দায় অজস্র শিকারী ও নিরীহ শিকার দেখছি। প্রতিটি ভারতীয় শুধু নয় বাংলাদেশী চ্যানেলেও দারুণ বিষাক্ত সহিংসতা শিখি,  আমরা কার্টুনে গেমস এ মানুষ মারার মাধ্যমে অস্ত্রের মাধ্যমে পয়েন্ট অর্জন  শিখি ।

তার মাধ্যমে সহিংস হতে শিখি। এরপর  সংসার, রাজপথ, সমাজ আমাদের জন্য হয়েওঠে এক বিগ হান্টিং গেম। এই গেমে আপন স্বার্থ সিদ্ধি টাই বড় কথা। কে মারা গেলো।   মুল্যবোধ কতটুকু রয়ে বা ক্ষয়ে গেল তাতে কারো কিছুই এসে যায় না। সৃজনশীল খেলা বা সমাজ উপযোগি গেমস বা সফটওয়্যার তৈরীর কথা কারা ভাবছেন? সবইত পাশ্চাত্য ধারার অন্ধ আবর্জনা ও ভারতীয় বাজারের একমুখী অনুকরণ আর এখানে ক্ষমতাটাই আসল কথা ।\

ছাত্র সমাজ বা সাধারণ সমাজের কিসের এতো দায়? আবার পুলিশী ঝামেলা ? আমার ধারণা শুধু নয় বিশ্বাস জীবন  সাহায্য করেছিলো কারণ জীবনানন্দের মাটির টান তার শরীরে তখনও কিছু ঘামের গন্ধ হয়ে লেগেছিলো বলে। আমাদের দেশে এখনও এইরকম কিছু চিন্তাশীল দরদী মানুষ আছেন বলেই এখনও এই দেশ নিবিঢ় সুন্দর ও সবুজ। তবুও মুল্য বোধের এই চরম অবক্ষয় ও সংবেদনশীলতা হারিয়ে অমানবিক স্বার্থ পরতার  যুগে ইচ্ছে করে বলি সর্বস্তেরে বাধ্যতামুলক  আদর্শলিপি পড়নো হোক। আজকের আধুনিক আদর্শীলপি নয়। আদি অক্রিত্রিম বিদ্যাসাগরিও আদর্শ লিপি ।

অফিস আদালত , স্কুল , কলেজ, মন্ত্রী , আমলা সবাই প্রতিদিন একবার  করে আদর্শ লিপি পড়বেন আর আত্নস্থ করবেন। স্মরণ করবেন সেইসব প্রাত:স্মরনীয়  ব্যক্তিত্বদের যারা বলেছিলেন ‘ মানুষের কাছে পেয়েছি যে, বাণী তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলেদিয়ে যাব- মানুষের দেওয়া প্রাণ ,’- অথবা প্রতিটি মানুষ একবর চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন লোককবি রমেশশীলের জীবনীতে যিনি ৭৪  পেরিয়ে ৭৫ এ পড়বার সময় জেলখনায় বসে তার সাথীদের বলেছিনে ‘৪৭ সালের গোলযোগে দেশ ভাঙল , ভেঙ্গে পড়লুম, কিন্তু ৫২ সালের ঢাকার মুসলিম ছাত্ররা গুলি খাইল’ আমি সে ঘটনা শুনে মনে মনে বললাম না, আবার দেশ জাগবে। জাগবে । আমার মনে গোস্বা এল। পুলিশ আমার বাড়িতে হানাদিল।

আমি পলাতক হলাম। তারপর একদিন গ্রেপ্তার হলাম। প্রথমে জেলে  আসতে ভয় হয়েছিলো। কিন্তু জেলে এসে যে, আদার স্নেহ যত্ন পেয়েছি তাতে আমার মনে হযেছে আমি যেন স্বর্গে এসেছি। ২১শে ফেব্রুয়রী যখন দেওয়ালের এপারে বসে ওপারের শ্লোগান শুনলাম আর পরদিন যখন দলে, দলে ছেলেরা -মেয়েরা বন্দীহয়ে আসছে , তখন ভাবলাম না, জীবন মরেনি জীবন আছে’- ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী বইমেলা প্রাঙ্গনে আক্রমনের শিকারহন ড. হুমায়ুন আজাদ তার আগেও প্রগতি শীলতার জন্য বিদায় নিয়েছেন সাংবদিক মানিক সাহা, পরবর্তীতে ব্লগার রাজীব, সর্বশেষ অভিজিৎ রায়।

কর্তব্যরত পুলিশের পাশে কিংকর্তব্য বিমূঢ় তার স্ত্রী  রাফিদা আহমেদ বন্যা। মনে হয় নিমজ্জিত অন্ধকারে আমাদের বাংলাদেশ। মনে হয় জীবন নেই । আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা হারিয়েছি তখনই দেখি জীবন আছে। আমাদের মাটির ছেলে জীবন। যখন বইমেলা থেকে ফিরবার পথে রিক্শার পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে এক ঘর্মাক্ত তরুনীকে আসতে দেখি।

রিকশা থামালে ধুলোমাখা আমারই পড়ে যাওয়া চাদর হাতে তুলে দিয়ে বলে এ্যাই আন্টি কথা শোনেনা কেন ? আপনার জন্য আমার  বয় ফ্রেন্ড দৌড়ায়া মরলো’- তখনও মনেহয় জীবন আছে। কিন্তু সঙ্গে সেই অজ্ঞাতনামা পোড়া মুখের তরুনী এসে বরবার হানাদিয়ে বলে যায় তোমাদের সংবেদনশীলতায় আমার সন্দেহ আছে। এই সমাজের , রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতায় আমার সন্দেহ আছে। মনেপড়ে সঞ্জীব পুরোহিতের কবিতার শেষকটি লাইন

এবং নিজেরো, কারন তা আমাকে অপরাধী করেউপচানো ডাস্টবিনের ভেতর থেকে জীবনের রসদ কুড়ানো এক শিশুর নাক,বাঁ হাত দীর্ঘ করে মামদো ভূত হ’য়ে চেপে ধরেছি।

রওশন আরা লীনা

গবেষক

বাংলা বিভাগ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

কুষ্টিয়া।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.