আজীবন সংগ্রামী প্রকৌশলী শেখ শহীদুল্লাহ

আগস্ট ২, ২০১৫

anu_mohamodআনু মোহাম্মদ : ৩১ জুলাই প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। শহীদুল্লাহ ভাই সম্পর্কে আমি কথা বলতে গেলে গত ১৭ বছরে গড়ে ওঠা জাতীয় কমিটির আন্দোলন আর তা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়গুলোই নানাভাবে আসতে থাকবে। কারণ এই আন্দোলনের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। আর এই আন্দোলনের নানা বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণা, লেখালেখি, বিতর্ক; লিফলেট, বুকলেট, পোষ্টার, বুলেটিন; এই আন্দোলনের নানাপর্বে মিছিল, লংমার্চ, ঘেরাও, শ্লোগান; সারাদেশের নানাপ্রান্ত সফর, পুলিশ- সন্ত্রাসী-মন্ত্রী-ভাড়াটে গবেষক মোকাবিলা; ব্যক্তি গ্রুপ সংগঠন রাজনৈতিক দল নিয়ে অসংখ্য সভা এইসব নিয়েই তাঁর সঙ্গে আমার প্রতিদিনের সম্পর্ক। আমাদের উদ্বেগ, ক্রোধ, বেদনা, আনন্দ, আশার অনেককিছুই অভিন্ন; বাংলাদেশ আর এইদেশের মানুষের জীবনমরণের বিষয় ঘিরে।

“শহীদুল্লাহ ভাই এর সাথে আমার প্রথম আলাপ ১৯৯৮ এর শেষে। প্রথম আলাপের আগেই তাঁকে দু’একবার দেখেছি, তাঁর সহজ সরল পোশাক চলাফেরা কথাবার্তা সবকিছু সেই এলিট ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছিল। সেসময় বাংলাদেশের গ্যাস ভারতে রফতানির তৎপরতা তুঙ্গে। বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের প্রধান তৎপরতা তখন দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রপ্তানির পক্ষে জনমত তৈরি করা। ‘গ্যাস রপ্তানি হলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে’ এরকম প্রচারণায় তখন আরও যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাংক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মন্ত্রী, আমলা, কনসালট্যান্ট, কতিপয় সংবাদপত্র।

লিখে, সেমিনারে, সমাবেশে তথ্য যুক্তি দিয়ে এসব প্রচারণার মোকাবিলা ছিল তখন জরুরী কাজ। জাতীয় কমিটি দ্রুত এসব তৎপরতার আস্থাভাজন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। জাতীয় কমিটির ভেতরে ও বাইরে অনেক বাম সংগঠন, বিশেষজ্ঞও সক্রিয় ছিলেন। সেই যে শুরু হলো, তারপর লংমার্চ রোডমার্চ নামে অনেকগুলো কর্মসূচি হয়েছে। ঢাকা-বিবিয়ানা (২০০২), ঢাকা- চট্টগ্রাম বন্দর(২০০২), ঢাকা- মংলা(২০০৩), ঢাকা- টেংরাটিলা (২০০৫), ঢাকা- ফুলবাড়ী (২০০৬), ঢাকা- বড়পুকুরিয়া- ফুলবাড়ী (২০১০), ঢাকা- চট্টগ্রাম (২০১১), ঢাকা- সুনেত্র (২০১১), ঢাকা-সুন্দরবন (২০১৩)। সভা সমাবেশ পদযাত্রা মিছিল অসংখ্য। এরমধ্যে সময় গেলো ১৭ বছর। মনে হয়নি কখনো যে শহীদুল্লাহ ভাইএর বয়স বেড়েছে। প্রথম পরিচয়ের সময় যেরকম দেখেছিলাম সেইরকমই আছেন, কখনো কখনো তাঁর শারীরিক সক্ষমতা আরও বেশি মনে হয়। এসব কর্মসূচিতে পায়ে হাঁটার বড় অংশ থাকে, খাওয়া বিশ্রাম ঘুম এগুলোরও অনিয়ম অনিশ্চয়তা থাকে। শহীদুল্লাহ ভাইকে এসবে কখনোই ক্লান্ত দেখিনি, বরং বয়সে কম আরও অনেকের জন্য তাঁর উদ্যম লজ্জার কারণ হয়েছে।

জাতীয় সম্পদ রক্ষার এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ১৭ বছরে বামদলগুলোর ঐক্য ক্রমেই সংহত রূপ নিয়েছে। শুধু সকলের শ্রদ্ধাভাজন বলে নয়, পুরো আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব তিনি মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করবার কারণে যে গতিশীলতা তৈরি হয় সেটাই তাঁকে কেন্দ্র করে এই ঐক্যকে সম্ভব ও সংহত করেছে। এতদিন ধরে জাতীয় কমিটির মধ্যে বাম প্রগতিশীল দলগুলোর যে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ও কাজ সেটা এই মঞ্চের অন্যতম সাফল্য, অন্যান্য সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। আর এর প্রধান কৃতিত্ব শহীদুল্লাহ ভাইকেই দিতে হবে।

জাতীয় কমিটির সঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞ সরাসরিই যুক্ত। শহীদুল্লাহ ভাই নিজে প্রকৌশল শাস্ত্রে শুধু পন্ডিত নন, তিনি যে শাখায় অসাধারণ কৃতিত্ব নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, সেই শাখার বহু প্রজন্মের মধ্যে তিনি সর্বজনের গুরু হিসেবে স্বীকৃত। পুর প্রকৌশলী হিসেবে শাস্ত্রীয় ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রে তাঁর পান্ডিত্য ও দক্ষতা এখন কিংবন্তীর পর্যায়ে। শাস্ত্রবিদ্যা থাকলেই কোন ব্যক্তির জ্ঞান বা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করা যায় না; শাস্ত্রে বিদ্যা ঐ ব্যক্তি কী কাজে ব্যবহার করতে চান, ঐ বিদ্যা তাঁর মানসিক বিকাশের সাথে সম্পকির্ত কিনা, জ্ঞান তার কাছে নিছক পুঁজি নাকি জগত ও মানুষকে উপলব্ধি কিংবা তাদের পাশে দাড়াঁনোর মাধ্যম ইত্যাদি সবকিছু নির্ভর করে ব্যক্তির মতাদর্শিক অবস্থানের উপর। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে শহীদুল্লাহ ভাইএর প্রখর রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সমৃদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞান এবং নির্মোহ বিশ্লেষণ অন্যতম অবলম্বন থেকেছে। শহীদুল্লাহ ভাইএর ধরনটিই হল এমন যে কোনকিছুই বিনা পরীক্ষা নিরীক্ষায় গ্রহণ করা যাবে না, জনপ্রিয় হলেই তার পেছনে ছোটা যাবে না, অবশ্যই প্রতিটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট তথ্য যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক কষ্টিপাথরে যাচাই করে তা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আন্দোলন তাই কখনোই হাওয়ার উপর অস্বচ্ছতা বা মূহুর্তের উত্তেজনা দিয়ে পরিচালিত হয়নি।
প্রকৌশল শাস্ত্রে সর্বজনস্বীকৃত গুরু হলেও প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধুমাত্র সেখানেই নিজেকে সীমিত রাখেননি, বিজ্ঞান দর্শন ধর্ম ইতিহাস রাজনীতি শাস্ত্র সম্পর্কেও তিনি পন্ডিত ব্যক্তি। মানুষ ও সমাজকে উপলব্ধি এবং সবরকমের আধিপত্য শোষণ ও নিপীড়ন থেকে এই সমাজকে মুক্ত করবার আগ্রহের কারণে নিজের জ্ঞানের পরিধি আরও গভীর করতে তিনি এখনও সদা যত্নশীল। পাঠ, অভিজ্ঞতা ও মনোযোগের এই ব্যাপ্তি তাঁকে সক্ষম করে তোলে যে কোন বিষয়কে একটি সামগ্রিকতার ভেতর উপলব্ধি করতে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বহু কর্তাব্যক্তির ভুল বা প্রতারণা উন্মোচন করতে। এরসঙ্গে মানুষ ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা তাঁকে তাঁর জ্ঞান চর্চাকে ব্যক্তির চাইতে বৃহত্তর প্রয়োজনের সাথে সম্পর্কিত করতে সাহায্য করে। সেকারণেই শহীদুল্লাহ ভাইএর শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও কর্তৃত্ব বরাবর বাংলাদেশের মানুষেরই কাজে লাগছে।

অসংখ্যবার আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফরে গেছি। বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেণ, লঞ্চ। যেতে আসতে জাতীয় সম্পদের বিভিন্ন দিক নিয়ে যেমন আলোচনা হয়, তেমনি আলোচনা হয় তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা, নদীর ভাঙন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক, জলবায়ু, আবাসন সমস্যা, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস। তাঁর পাঠের কোন সীমা নেই। কুরআন হাদিস খুব ভালো জানেন, আরবী ভাষাতেও তাঁর দখল আছে। সুতরাং এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা খুবই আকর্ষণীয়। শহীদুল্লাহ ভাই খুবই মনোযোগী পাঠক। তাঁর অধ্যয়নের পদ্ধতি খুবই নিবিড়। সাম্প্রতিক সময়ের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বিতর্ক বা তথ্যাবলীও তাঁর মনোযোগের বাইরে নয়।
শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিধি নয়, বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করতে করতে, বিস্ময় এবং মুগ্ধতার সঙ্গে তাঁর কঠিন মনোবল, সংযম, শৃঙ্খলা ও সক্ষমতাও দেখি। যেকোন স্থানে যেকোন পরিবেশে তিনি খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, যেকোন খাওয়া তাঁর পক্ষে হজম করা সম্ভব, যেকোন যানবাহনে তিনি চলাফেরা করতে পারেন, পুকুর বা দীঘি বা নদীতে সাঁতড়ে নিতে পারেন। বিপ্লবী নেতা হবার পূর্বশর্ত হিসেবে আমরা শুনি শ্রেণীচ্যুতির কথা। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক বাম নেতার মধ্যে যা দেখিনি তা পেয়েছি শহীদুল্লাহ ভাইয়ের মধ্যে।

শহীদুল্লাহ ভাই আপাত দৃষ্টিতে খুবই সোজাসাপ্টা, কঠিন, প্রকৌশল বিদ্যার মতোই ছক-মাপ-কাঠামোবদ্ধ। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, তাঁর জীবনের প্রধান পরিচালিকা শক্তি মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। গভীর সংবেদনশীলতাই তাঁকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর একগুঁয়ে রাজনৈতিক সাংগঠনিক তৎপরতায় নিয়োজিত রাখে।

নিজের জীবন নিয়ে কিংবা যে কোন বিষয়ে নিজের মতদ্বিমত বিরক্তি ক্রোধ প্রকাশে তিনি সম্পূর্ণ দ্বিধাশূণ্য। নিজের জীবনের অনেক বিষয়, বিভিন্ন ঘটনাবলী, কিংবা সহযোদ্ধার বক্তব্য সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশে তার নি:সংকোচ ধরন অনেক সময় অস্বস্তিকর পরিবেশও তৈরি করে। আমি কখনো কখনো বলেছিও তা। তিনি বলেন, ‘আমার করার কিছুই নাই, আমি সবকিছুই স্বচ্ছ রাখতে চাই।’

মানুষের প্রতি প্রবল ভালবাসাই নিষ্ঠুর জগতের চালক লুটেরা নির্যাতক সুবিধাভোগীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আনতে পারে। এই ভালবাসাই তৈরি করে শহীদুল্লাহর মতো একগুঁয়ে অবিশ্রামী নির্ভয় অক্লান্ত নির্মোহ সংগ্রামী বিস্ময়। এইদেশ এইখানে থাকবে না, আত্মমর্যাদা ও মালিকানার এই লড়াই আরও বহু লড়াইএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই দেশকে মানুষের সমাজে নিয়ে যাবে। বৈষম্য নিপীড়নমুক্ত সাম্যের এক স্বাভাবিক জগতে মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করতে সক্ষম হবে। জীবন ও সম্পদের উপর এই দেশের মানুষ তার পূর্ণ কর্তৃত্ব পাবে। শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সেই সমাজ নির্মাণের চিন্তা ও লড়াইএর অসামান্য নেতা-সংগঠক-কারিগর। তাঁর ৮৪তম জন্মদিনে সর্বজনের পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ২, ২০১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.