খালেদা আদালতে যাচ্ছেন রোববার

এপ্রিল ৪, ২০১৫

khaleda ziaঢাকা জার্নাল: জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রোববার (৫ এপ্রিল) আদালতে যাচ্ছেন। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি অবশ্য শনিবার (৪ এপ্রিল) রাতে নেবেন তিনি। ‍যাওয়ার সিদ্ধান্তটি বাতিলের সিদ্ধান্তও নির্ভর করছে রোববার সকালের পরিস্থিতির ওপরে।

শনিবার খালেদার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বাংলানিউজকে তার আদালতে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কার্যালয়ে অবস্থানরত স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান, খালেদার উপদেষ্টা ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনের সঙ্গে আলাপেও আদালতে যাওয়ার বিষয়ে খালেদার ইতিবাচক মনোভাবের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে।

অবশ্য তাদের বক্তব্যে রোববার সকালের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ‍যাওয়ার সিদ্ধান্তটি বাতিলের আশঙ্কাও থাকছে। এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি শনিবার রাতে জানা যাবে বলেও জানিয়েছেন তারা।

অন্যান্য দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর বক্তব্যেও একই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারা জানাচ্ছেন, আদালতে যাওয়ার জন্য এর আগের তারিখগুলোর চেয়ে এবার খালেদা অনেক বেশি আন্তরিক। তিনি আদালতে যেতে চাচ্ছেন। পরিস্থিতি সুবিধাজনক ও নিরাপত্তা পেলে এবার তিনি কার্যালয় থেকে বের হবেন।

খালেদার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানাচ্ছে, আদালতে যাওয়ার এর আগের তারিখগুলোর চেয়ে এবার খালেদা অনেক বেশি আন্তরিক। তিনি আদালতে যেতে চাচ্ছেন। রোববারের প্রস্তুতি হিসেবে শনিবার (০৪ এপ্রিল) তিনি কার্যালয় ছেড়ে তার বাসায় ওঠারও সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে খালেদার দুই আইনজীবী অবশ্য এখনো ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা’র কথাই বলছেন। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বলতে কী বোঝাচ্ছেন সেটিও তাদের কথায় স্পষ্ট নয়।

খালেদার বিরোধী পক্ষের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন তার এই চাহিদায়। তারা বলছেন, যেহেতু খালেদা এখন বিরোধী দলীয় নেতাও নন, তাই কোনো প্রটোকল সেভাবে তার প্রাপ্য নয়। সেক্ষেত্রে কোন ধরনের নিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে? আদালতে যাতায়াতের পথে পুলিশ তাকে ঘের-নিরাপত্তা দেবে, নাকি আরও কিছু চান খালেদা?

এসব প্রসঙ্গে জমির, খন্দকার মাহবুব ও খোকন সরাসরি কোনো নির্দেশনা বা সুপারিশ তুলে ধরেননি।

বাংলানিউজকে জমির বলেন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে তার নিরাপত্তার জন্য যা করা দরকার, তাই চাওয়া হয়েছে। আশা করি, সরকার বিষয়টি বুঝবে। প্রশাসনতো জানে, কাকে কেমন নিরাপত্তা দেওয়া প্রয়োজন। আমরা তাদের সহযোগিতা চাই।

‘খালেদা জিয়া বরাবরই আদালতের প্রতি বিনম্র। এর আগে নিয়মানুযায়ী তিনি আদালতে গিয়েছিলেন ও এক পর্যায়ে তার জীবন ঝুঁকিতে পড়েছিল। সে পরিস্থিতি যেন আর না হয়, তাই কাম্য। খালেদার জীবন ও সম্মানের সুরক্ষায় পরিস্থিতি তৈরির অনুরোধই আমরা করেছি প্রশাসনের কাছে। এর বেশি কিছু না’- বাংলানিউজকে বলেন খন্দকার মাহবুব।

দলটির নেতারা বলছেন, রোববার সকালে নিরাপত্তার বিষয়টি সন্তোষজনক পাওয়া গেলে খালেদা আদালতে যাবেন। পরিস্থিতি পছন্দ হলে, নিজেকে ও সঙ্গীদের নিরাপদ দেখলে এবার আর মত ঘোরাবেন না তিনি। তবে পরিস্থিতি পছন্দ না হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন ‘আপোষহীন’ খ্যাত এ রাজনীতিক।

এদিকে আদালতে যাওয়ার বিষয়ে এবারের আগ্রহটিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন খালেদার বিরোধীপক্ষের কেউ কেউ। তারা বলছেন, প্রথমে খুব ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন খালেদা, যাতে শেষ মুহুর্তে কোনো অজুহাতে বেঁকে বসার সুবিধা পান।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই দুর্নীতি মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলছে রাজধানীর বকশিবাজারে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে স্থাপিত তৃতীয় বিশেষ জজ আবু আহমেদ জমাদারের অস্থায়ী আদালতে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে রোববার। খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েও শুনানি হবে এদিন।

গত ৪ মার্চ শুনানি শেষে দুই দুর্নীতি মামলায় প্রধান আসামি খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বহাল রাখেন আদালত। অন্য দু’জন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি। তারা হচ্ছেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে শুনানিতে অনুপস্থিত থাকায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

আসামিপক্ষের একটি আবেদন মঞ্জুর করে আদালত ওইদিন মামলাটির অপর আসামি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমান আগের মতোই আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন বলেও আদেশ দেন।

খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, আদেশ সংশোধন, জামিন বহাল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে অনুপস্থিতিসহ ওইদিন মোট সাতটি আবেদন জানিয়েছিলেন আসামিপক্ষ।

আবেদনগুলোর নিষ্পত্তির পর চারটি আবেদন নথিভুক্ত রেখে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পিছিয়ে দেন আদালত। ফলে রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী আদালতে উপস্থিত থাকলেও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার আসামি মোট ছয়জন। খালেদা-তারেক ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারিভুক্ত দু’জন ছাড়া অন্য দু’জন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট আসামি চারজন। খালেদা ছাড়া অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন- খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খান জামিনে আছেন। হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাতজন সাক্ষী হচ্ছেন- দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার বাদী হারুন-অর রশিদ, সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার হারুনুর রশিদ, অফিসার (ক্যাশ) শফিউদ্দিন মিয়া, আবুল খায়ের, প্রাইম ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দা নাজমা পারভীন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আফজাল হোসেন।

সাক্ষীদের মধ্যে এ পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন বাদী ও প্রথম সাক্ষী দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে কোনো আসামি না থাকায় আসামিপক্ষের জেরা বাতিল করেছিলেন আদালত।

তবে তারেক রহমানের পক্ষে আগামী ধার্য তারিখে (৫ এপ্রিল) হারুন-অর-রশিদকে জেরা করার সুযোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া।

২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করে দুদক। এতিমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।

অন্যদিকে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করা হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে এ মামলা দায়ের করা হয়।

দুই মামলারই বাদী হলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত ১ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি।

জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ খান।

গত বছরের ১৯ মার্চ এ দুই দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ঢাকা তৃতীয় ও বিশেষ জজ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়।

খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে চার্জ গঠন করা হয় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর আট আসামির বিরুদ্ধেও।

গত বছরের ৭ মে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলা ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ সংক্রান্ত বিশেষ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঢাকার মেট্রোপলিটন দায়রা জজ আদালত ভবনের পরিবর্তে ঢাকা মহানগরের বকশীবাজার এলাকার সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালত ভবনে চালানোর আদেশ জারি করে।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশে আইন মন্ত্রণালয় এ আদালতের আগের বিচারক বাসুদেব রায়ের বদলে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ হিসাবে নিয়োগ দেয় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু আহমেদ জমাদারকে।

আগের বিচারকের প্রতিও অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানানো ছাড়াও তার আদালতে বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে এজলাসকক্ষেই বিশৃঙ্খলা ও হই-হট্টগোল এবং বিচারকের প্রতি কটূক্তি করে আসছিলেন খালেদার আইনজীবীরা।

এ পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির পরামর্শে বিচারক বদল করা হয়।

নানা কারণ দেখিয়ে মামলা দু’টির শুনানির জন্য নির্ধারিত ৬৫ কার্যদিবসের মধ্যে ৫৮ কার্যদিবসই অনুপস্থিত থেকেছেন খালেদা জিয়া, হাজির হয়েছেন মাত্র ৭ দিন।

ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ০৪, ২০১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.