আজও স্বীকৃতি পায়নি কলরেডি

মার্চ ৮, ২০১৫

march 7ঢাকা জার্নাল : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ঐতিহাসিক এ দিনটিতে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিকামী বাঙালি জাতি পেয়েছিল তার স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা।

আর সেই দিক-নির্দেশনা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দিয়েছিলেন তার ১৯ মিনিটের ভাষণের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির সেই তর্জনী উচানো বজ্রকণ্ঠ মুক্তিকামী বাঙালি শুনেছিল ‘কলরেডি’র শব্দযন্ত্রের ব্যবস্থা যাকে আমরা বলি মাইক (লাউড স্পিকার) দিয়ে।

‘কলরেডি’ প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মাইক সরবরাহ করতো। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই জনসভায় ‘কলরেডি’ মাইক সরবরাহ করেছিল। বঙ্গবন্ধুও সেদিন ‘কলরেডি’র মাইক্রোফোন ব্যবহার করে ভাষণ দিয়েছিলেন। আর ওই প্রতিষ্ঠানের মাইকে দিক থেকে দিগন্তে প্রচারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক ভাষণটি।

সেই শাণিত প্রবাহের ‘কলরেডি’র মহানায়কেরা হলেন- দয়াল ঘোষ এবং তার দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও কানাই ঘোষ।

ইতিহাসের রাজসাক্ষী ‘কলরেডি’র প্রতিষ্ঠাতা কানাই ঘোষ শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে আজও বেঁচে থাকলেও পরলোকগমন করেছেন তার বাকি দুই ভাই। বড়ভাই দয়াল ঘোষের মৃত্যু সাল না জানা গেলেও হরিপদ ঘোষ মারা যান ২০০৪ সালে।

বাবা হরিপদ ঘোষের মৃত্যুর পর ‘কলরেডি’র হাল ধরেন সাগর ঘোষ।

সেদিনের সেই সময়ে (১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময়) কী ঘটেছিল? কীভাবে লাগানো হয়েছিল শব্দযন্ত্র? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয়, সাগর ঘোষের সঙ্গে।

তিনি বাংলানিউজকে জানালেন, বাবা-কাকার মুখে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গল্প শুনেছেন। সেই সঙ্গে শুনেছেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়ার পরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্ট ও চেপে রাখা ক্ষোভ।

সাগর ঘোষ জানান, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাবা এবং কাকাদের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে সূত্র ধরেই ৭ মার্চের জনসভায় শব্দযন্ত্র সরবরাহে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশ পায় ‘কলরেডি’।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়েই তার বাবা হরিপদ ও তার দুই ভাই ৫ মার্চ ছুটে যান রেসকোর্সের সেই সভাস্থলে। সঙ্গে জনা বিশেক কর্মচারী। এরপর পুরো সভাস্থলে লাগানো হলো দেড় শতাধিক মাইক। এর মধ্যে বেশিরভাগ মাইক তৈরি করা হয়েছে, শুধুমাত্র সমাবেশের জন্যই।

মাইক তৈরির এ কাজটি নিজের হাতেই করেছেন ‘কলরেডি’র প্রতিষ্ঠাতারা। তৎকালীন সময়ে দেশীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে মাইকগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সেই মাইক লাগাতে গিয়ে উপেক্ষা করতে হয়েছে পাকিস্তানি কুলাঙ্গারদের রক্তচক্ষু।

৭ মার্চের উত্তাল দিনটির কথা বলতে গিয়ে সাগর ঘোষ বলেন, পুরো মাঠ (তৎতালীন রেসকোর্স ময়দান) ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। মাইকের নির্ধারিত সীমানাকে অতিক্রম করেছিল জনসমুদ্র। প্রথমে ৭০ থেকে ৮০টি মাইক লাগানোর পরিকল্পনা করা হলেও জনসমুদ্রের ঢেউ দেখে মাইক সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। সভা শুরু হওয়ার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল মাইক লাগানোর কাজ।

সভাশেষে, পাকিস্থানিদের ভয়ে সব মাইক খোলা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত আর বাংলাদেশ নামে দেশটির সৃষ্টির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত সেই মাইকগুলো আর মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি আজও সংরক্ষণ করে রেখেছে ‘কলরেডি’। সেদিন যেসব অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৭টি এখনও সংরক্ষণ করা রয়েছে। এছাড়া চারটি মাইক্রোফোনও সংরক্ষণ করা রয়েছে।

‘কলরেডি’র প্রতিষ্ঠার সময়কাল বলতে গিয়ে সাগর ঘোষ বলেন, ১৯৪৮ সালে দুই ভাই দয়াল ঘোষ ও হরিপদ ঘোষ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মাইকের ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আরজু লাইট হাউস’ হলেও এর বছরখানেক পরেই নতুন নামকরণ হয়- ‘কলরেডি’।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার-পূর্ব ও পরবর্তী সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সভা-সমাবেশে ‘কলরেডি’র উপস্থিতি ছিল খুবই স্বাভাবিক। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন,  ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান আর ৭০ -এর নির্বাচনে ‘কলরেডি’  ছিল ইতিহাসের নির্বাক সাক্ষী। এসব সরঞ্জামাদি ও ঐতিহাসিক ঘটনা লিখে ‘কলরেডি’ নামে ২০১০ সালে একটি ওয়েবাসাইট তৈরি করা হয়েছে। ওয়েবসাইটটির ঠিকানা- www.callreadybd.com।

সালগুলোর কথা বলতে বলতে সাগর ঘোষ দেখাচ্ছিলেন, সে সময়কার ছবি।

স্বাধীনতা পরবর্তী ‘কলরেডি’র ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফেরেন, তখনও স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্যও এই ‘কলরেডি’র মাইক দিয়েই প্রচারিত হয়েছে।

সাগর ঘোষ বলেন, শুধু তাই-ই নয়, বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই সময় ‘কলরেডি’র মাইক্রোফোনে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন।

তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে ইতিহাসের রাজসাক্ষী শব্দযন্ত্রগুলো (মাইক ও অ্যাম্প্লিফায়ার, মাইক্রোফোন) ব্যক্তিগতভাবে সংরক্ষণ করা হলেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অসামান্য অবদানের জন্যও প্রতিষ্ঠানটির কপালে জোটেনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বা কোনো ধরনের স্বীকৃতি।

সাগর ঘোষ আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়েপড়া এ  প্রতিষ্ঠানটিকে আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের সম্মাননা দেওয়া হয়নি। টাকা দিয়ে ‘কলরেডি’র সেই দিনের সার্ভিসকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।

এ জন্য দরকার স্বীকৃতি। আর সেই স্বীকৃতির অপেক্ষায় বাবার অসুস্থের সময় দেখতে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে চেয়ে আছি।
লেখক : ইমরান আহমেদ,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।

ঢাকা জার্নাল, মার্চ ০৭, ২০১৫।

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.