ফুল ফ্রি একুশে স্কুল

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫

Ekushe 2ঢাকা জার্নাল: কেউ কেউ নিজের নাম জাহির করতে, কিংবা পরিবারের সদস্যদের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু এখনও অনেকে রয়েছেন যারা এই ধারার বাইরে নিভৃতে সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন। 

এমনই একজন ব্যক্তিত্ব নাজমুল আহসান মজুমদার। তিনি নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন একুশে গার্লস স্কুল। ভিন্নমাত্রা এবং ভিন্ন ধারার এই প্রতিষ্ঠানটি ফ্রি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও এরই মধ্যে শিক্ষা এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। 

ফুল ফ্রি বলতে যা বুঝায় তার সবকিছুই বিদ্যমান স্কুলটিতে। বেতনতো নেইই, পরীক্ষার ফি পর্যন্ত আদায় করা হয় না। আর ক্ষেত্র বিশেষে স্কুল ড্রেসও সরবরাহ করা হয়। পতাকার রঙের সঙ্গে মেলানো স্কুল ড্রেস ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। ছাত্রীদের সবুজ রঙের পাজামা ও স্কার্ফ আর লাল রঙয়ের জামা। নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া উপভোগ করেন অনেক পথচারীরা।
 
শুধু একদিন নয় সারা বছর লাল সবুজকে ধারণ করতেই শিক্ষার্থীদের এই পোষাক নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠাতা নিজেই। শুধু পোষাকে নয়, জাতীয় দিবসগুলো সাড়াম্বরে উদযাপন করা হয়। নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
 
Ekushe 1কোন সীমাবদ্ধতাই তাদের দমাতে পারেনি। শহীদ মিনার নেইতো কি হয়েছে, তাতে একুশ উদযাপন হবে না তাতো হতে পারে না। স্কুলের ছাত্রীরা মাথায় করে মাটি ও কলাগাছ এনে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করেছিল। 

প্রত্যেকটি জাতীয় দিবসে স্থানীয় কোন মুক্তিযোদ্ধাকে অতিথি করা হয়। আর তিনিই আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। গত মৌসুমে গ্রামের একুশের মেয়েরা আন্ত:স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় রানার আপ হয়। আর কাবাডিতে হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন।

অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্কুলটি যাত্রা করে গ্রামের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়েই। যাদের সকলেরই অর্থাভাবে অথবা দূরে স্কুল হওয়ায় পাঠদান চুকে গিয়েছিল। ওই ছাত্রীরাই এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
 
তাদেরই একজন জোসনা খাতুন (পিতা রুহুল আমিন) জানান, আগে পালিশারা হাই স্কুলে পড়তাম। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেক দূর, যেতে অনেক সমস্যার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর তাতে ভর্তি হয়েছি। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই।

সব কিছুতেই ব্যতিক্রমের ছোঁয়া। দেশের স্কুলগুলো তাদের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু একুশে গার্লস স্কুল এখনও পরীক্ষার মাঝে মাঝে ক্লাস নিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। যদিও শ্রেণি কক্ষ সংকটের কারণে দশম শ্রেণির ক্লাসের সঙ্গে বসানো হয়েছে পরীক্ষার্থীদের।
 
গ্রামটিতে আগে কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। দুই কিলোমিটার পূর্বে পালিশারা হাইস্কুল আর উত্তর-পশ্চিমে তিন কিলোমিটার দূরে বেলচো হাই স্কুলে যেতে হত এই গ্রামের মেয়েদের। যে কারণে শিক্ষার হার ছিল অনেক কম। বিশেষ করে ছাত্রীদের অবস্থান ছিল নিম্নে। অনেক কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হত। সেই চিত্র এখন বদলে গেছে।

Ekushe 3সীমাবদ্ধতা যে কোন বাধা হতে পারে না তার প্রমাণ মেলে স্কুলটিতে। নিজস্ব কোন ভবন নেই। একটি টিনসেড ঘর ও একটি পাঠাগারে অস্থায়ী পাটিশন দিয়ে চলছে ক্লাস। অথচ ফলাফল আশা জাগানিয়া। জেএসসি পরীক্ষায় ২০১২ সালে প্রথম ২৫ জন ছাত্রী অংশ নিয়ে শতভাগ পাশ করে। এরপরের বছর ৩০ জন জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, শতভাগ পাশসহ ৫ জন জিপিএ পাঁচ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। 
 
প্রতিষ্ঠাতারাও বেজায় খুশি। এরই মধ্যে ৬৮ শতাংশ জমি কিনে তাতে ভবন নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছেন। এর সবটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠাতাদের স্বেচ্ছা প্রদত্ত অর্থায়নে। মোট ৭০ জন উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা প্রতিমাসে অর্থসহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই টাকাতেই চলছে শিক্ষকদের মাসের বেতন।

অতিরিক্ত সময় ক্লাস নিতে হয় শিক্ষকদের। এতে করে শিক্ষকরা দুপুরে খাওয়ার জন্য বাড়ি যেতে পারে না। সে কারণে শিক্ষকদের খাবার তৈরি করা হয় স্কুলেই। শিক্ষকদের কক্ষের এক কোনে রান্না হয় নিয়মিত। খাবার তৈরির চাল ডাল সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। 
 
উদ্যোক্তাদের মধ্যে অগ্রভাগে রয়েছেন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল আহসান মজুমদার। তিনি জানান, এই স্কুলটা হবে আমাদের স্কুল। কেউ যেন বলতে না পারে এটা আমার পরিবার প্রতিষ্ঠা করেছে।
 
তার দুই মেয়ে পড়েন ভিকারুন নিসা স্কুলে। সেখানে গেলে তার মধ্যে ভালো লাগা এবং বেদনা একই সঙ্গে ভর করে। কারণ তার গ্রামের মেয়েরা ভালো স্কুলে পড়তে পারছে না। ছোট বেলায় দেখেছেন তার আপন বোনের পাঠ চুকে যেতে। সেই কষ্ট আজও তাকে পীড়া দেয়। সে কারণে এই উদ্যোগ।
 
পোষাকের বৈচিত্র প্রসঙ্গে জানান, আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে বাহান্ন, একাত্তর আর লাল-সবুজ। সে কারণে পোষাকে এই ভিন্নতা আনা হয়েছে। যাতে ছাত্রীরা মেধা ও মননে দেশকে ভালোবাসতে পারে।
 
২০১১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ৫০ জন মিলেছিলেন একটি চা চক্রে। সেখানেই আলোচনা এবং নামকরণ করা হয়। এর ৪ দিনের মাথায় স্থান নির্ধারণ করে গণবিদ্যা পাঠাগারের ভবনে যাত্রা শুরু করে। পাঠাগারটিও তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
 
স্কুলের জন্য অনেকে জমি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের শর্ত ছিল স্কুল হতে হবে তাদের নামে। কিন্তু তারা সেই পথে যাননি। ৬৮ জন প্রত্যেকে এক শতাংশ জমির মূল্য দিয়ে একটি জমি কিনেছেন। স্কুল থেকে কয়েক বিঘা দূরত্বে। স্বপ্ন দেখেন এক সময় অনেক খ্যাতিযশ অর্জনে সক্ষম হবে একুশে গার্লস স্কুল। 
 
নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, আমার নিজের বোন স্কুল অভাবে পড়তে পারেনি। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার আগেও প্রাইমারি পাশের পরেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হত। এখন পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে।
 
শুরুতে উদ্যোক্তা সহযোগীদের যে সাড়া ছিল তাতে কিছুটা ভাটার টান পড়েছে সে কথাও অকপটে স্বীকার করেন নেন তিনি। যে কারণে শিক্ষকদের যথা সময়ে বেতন দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শিগগিরই আবার বসে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন তিনি।
 
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে। প্রধান শিক্ষকসহ ফুল টাইম শিক্ষক রয়েছেন ৮ জন। আর খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে চলছে ব্যতিক্রমী এই স্কুলটি। বর্তমানে ২২৬ জন ছাত্রী রয়েছে। সংকট অনেক কিন্তু অদম্য পথচলার ‍সামনে সবই খড়কুটো বলে জানালেন প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক পাটোয়ারী। 
 
আগে অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। অবসরে যাওয়ার পর একুশের দায়িত্ব নিয়েছেন। স্কুলটাই তার কাছে এখন ধ্যান জ্ঞান। আসেন সেই সকালে ফেরেন সন্ধ্যার পরে।
 
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একুশে গার্লস স্কুল। শুধু প্রতিষ্ঠাতারা নন, ছাত্রী এমনকি গ্রামবাসীও মনে করেন স্কুলটি তাদের। সৌজন্যে বাংলানিউজ। 

লেখক: সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজ।

ঢাকা জার্নাল, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.