তোমায় আমি দেখেছিলাম
নভেম্বর ২৯, ২০১৩ নিত্যানন্দ খাঁ: জীবনানন্দ দাশের কবিতা/ শৈলী বিচার ও পাঠ বিশ্লেষণ, ড. প্রকাশকুমার মাইতি, সাহিত্য সঙ্গী, ১০০ টা.
বাঙালির জীবনানন্দ চর্চার ইতিহাস বড় কম নয়। তাঁর জীবন, তাঁর কবিতা এবং সম্প্রতি তাঁর উপন্যাস- সবই এই চর্চার অন্তর্গত। ড. প্রকাশকুমার মাইতির জীবনানন্দ দাশের কবিতা/ শৈলী বিচার ও পাঠ বিশ্লেষণ সেই চর্চার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। জীবনানন্দের কবিতার গলিঘুঁজি, পায়ে হাঁটা পথ, পথে কুড়িয়ে পাওয়া টুকরো মুহূর্ত এবং সর্বোপরি অন্তর্গত রক্তের খেলাঘর, সবই যেন মলাটবদ্ধ হয়ে এই বইতে ফুটে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে প্রকাশবাবুর শাণিত বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসনীয়।
বইয়ের পাঁচটি অধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে জীবনকথা, কবিতার নানা প্রসঙ্গ, রচনাপঞ্জি, শৈলীবিচার এবং জীবনানন্দের প্রায় চুয়াল্লিশটি কবিতার হৃদয়গ্রাহী পাঠ বিশ্লেষণ। বরিশালের ‘সর্বানন্দভবন’ থেকে কলকাতার ‘১৮৩, ল্যান্সডাউন রোড’ এই সমস্তটাই জীবনানন্দের চারণভূমি। কখনো প্রকৃতির অবিরল অবসর আবার কখনো নাগরিক জীবনের প্রবহমান ব্যস্ততা। সবশেষে হাজার বছরের পথ চলা শেষ হয় কোন উদ্ধত ট্রামের ধাক্কায়। দু’দণ্ডের শান্তিতে চোখ বোজে ক্লান্ত প্রাণ এক। এই সম্পূর্ন ছবিটি ফুটে উঠেছে জীবনকথায়। তবে আমার মতে এই বইয়ের যে বিশেষত্বটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তা হল- দ্বিতীয় অধ্যায়ে, কবিতার নানা প্রসঙ্গ-র অন্তর্গত ‘নানা রঙের মেলা’, ‘বিদেশী অনুষঙ্গ’ আর ‘পরাবাস্তব’।যে ‘নগ্ন নির্জন হাত’, ‘আট বছর আগের একদিন’ প্রশ্রয় পেয়েছিল ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’-র কাছে, সেই হাতই আবার রঙিন হয়েছে- লাল লাল বটের ফলে, নক্ষত্রের নীল ফুলে, লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়, হলুদ পাতার ভিড়ে। শুধু অধ্যাপনার সূত্রেই নয়, গভীর রসবোধ থেকেও উৎসাহিত হয়ে জীবনানন্দ শেলি, কীটস, এলিয়ট, অ্যালান পো প্রমুখ কবির কাব্য পাঠ করতেন। ফলে তাঁর বিভিন্ন কবিতায় যেমন- ‘অবসরের গান’, ‘হাঁস’, ‘হায় চিল’, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদিতে যথাক্রমে- ‘Ode to a Nightingale’, ‘The Wild Swans at Coole’, ‘He Reproves the Curlew’, ‘To Helen’এর ছায়া পড়েছে। এছাড়াও বিদেশী ব্যক্তি, স্থান ও প্রসঙ্গ বারবার এসেছে জীবনানন্দের কবিতায়। তারই একটি সুগঠিত উদাহরণ লেখক নির্বাচিত কুড়িটি কবিতার মাধ্যমে এই বইতে কবিতার নানা প্রসঙ্গ-র অন্তর্গত ‘বিদেশী অনুষঙ্গ’-তে দেখিয়েছেন। যা একই সাথে তুলনামূলক আলচনার ক্ষেত্রেও বিশেষ উপযোগী। বলা বাহুল্য, এই ধরনের উদাহরণ জীবনানন্দের আলোচনা বিষয়ক বইতে এই প্রথম দেখা গেল। “যত্নে-গড়া চাকচিক্য দিয়ে উদ্ভট উপাদানের অস্তিত্ত্বকে ভুলে থাকতে পারছে না আধুনিক মানুষ; গোটা জীবনই অ্যাবসার্ড হয়ে পড়েছে।”(আধুনিকতার স্বরূপ ও পরাবাস্তব, তপধীর ভট্টাচার্য) এ যেন জীবনানেন্দর কবিতারই সমর্থনবাক্য। জীবনানন্দের আগে পরাবাস্তবের ব্যবহার খুব কমই দেখা গেছে বাংলা কবিতায়। ‘আট বছর আগের এক দিন’, ‘স্বপ্নের হাতে’, ‘মৃত্যুর আগে’ সহ আরও বেশ কয়েকটি কবিতায় এই পরা বাস্তববাদকে ব্যবহার করেছেন জীবনানন্দ। এই প্রসঙ্গেরই এক সংক্ষিপ্ত অথচ পর্যাপ্ত আলোচনা এই বইতে পাওয়া যাবে।
প্রকাশবাবু বর্তমানে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে বাংলা ভাষাবিজ্ঞান চর্চায়। ফলে এই বইতে শৈলীবিচারের অধ্যায়ে তাঁর ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুন্সিয়ানা দুইই চোখে পড়বার মতো। বইয়ের পরিশিষ্টে রয়েছে বেশকিছু দুর্লভ ছবির এবং জীবনানন্দ বিষয়ক অনুপ্রশ্নের এক অভিনব সংযোজন। রুচিপূর্ণ প্রচ্ছদ, ঋজু ভাষা এবং গবেষণাধর্মিতা নিয়ে এককথায় এই বইটি, ড. প্রকাশকুমার মাইতির এক সম্ভাবনাময় প্রয়াস।
লেখক- নিত্যানন্দ খাঁ
Research scholar
Banaras Hindu University
India.
08960257267
roy.neel21@mail.com