মত-অমত

মূল্যস্ফীতি, সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্য

 

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

মূল্যস্ফীতি কমেছে–ঠিক এমন একটি সরকারি ঘোষণার পর পরই যেন দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বাড়তে শুরু করে। এখন পরিস্থিতি একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত। সরকার বলছে সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। নি:সন্দেহে অগ্রগতি। কিন্তু এর সাথে মিলছে না খাদ্য মূল্যস্ফীতির চিত্র। সরকার যে মূল্যস্ফীতির হার দেখাচ্ছে তা দিয়ে পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। বিশেষ করে গরিব মানুষের যেসব দরকার বিশেষত খাদ্য—দ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস—সেগুলোর দাম অনেক বেশি বেড়েছে। সরকারের হিসাবেই এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

সরকার নানা প্রচেষ্টা নিচ্ছে যেমন আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাচ্ছে, জরুরী ভিত্তিতে কিছু আমদানি করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। চাল, ডাল, ডিম, আলু, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, স্যালাইন, ওষুধ, পরিবহন কিংবা বাসাভাড়া যাই হোক না কেন, তার দাম যখন বাড়তে থাকে তখন সবাই অথনীতির স্বাভাবিক চিত্র চাহিদা—জোগানের দিকে নজর দিতে বলে। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে সরবরাহ ঘাটতি না থাকলেও দাম হু হু করে বাড়ছে। জিনিসপত্রের দাম ক্ষণে ক্ষণে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে যা অর্থশাস্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। ঢাকার বাজারে এখন কোন সবজির দামই ১২০ টাকার নিচে নেই।

পরিস্থিতি যা হয়েছে তাতে গরিব মানুষের পক্ষে খাবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নীরবে গরিব মানুষের টাকা লুট করছে। যেসব পদক্ষেপের কথা সবাই বলছে তার একটি হলো সঠিক মনিটরিং এবং নিয়ন্ত্রণ। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করলে বাজারের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, এবং বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হলে তা দ্রুত মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। সেটা করেও ইতিবাচক কিছু ঘটছে না।

জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আমাদের এখানে সিন্ডিকেট কথাটি বেশি উচ্চারিত হয়। কিন্তু সিন্ডিকেট সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাই বেশি জরুরি। কারণ এমন অনেক পণ্যের বাজারদর চড়া থাকছে যেগুলো দেশে উৎপাদিত এবং উৎপাদনের স্তরে সেই পণ্যের দাম ভোক্তা পর্যায়ে দামের তুলনায় অনেক কম। যখন ঢাকার বাজারে মাছ ফল সবজির দাম বাড়ছে তখন উত্তরাঞ্চল সহ দূরবর্তী এলাকায় উৎপাদকের প্রাপ্তি দাম বাড়ছে না। কৃষক যখন বিক্রি করছে ২০ টাকায়, তখন আমাদের কিনতে হচ্ছে ১২০ টাকায়।

তবে কি এই সিস্টেমের মধ্যেই রয়েছে কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়া? তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করাই বেশি প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে?
সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো সহ শুল্ক ও করের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করছে। সরকার আরেকটি কাজ করতে পারে। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্যের জন্য ভর্তুকি প্রদান করতে পারে, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষ কম দামে সেই পণ্যগুলো পেতে পারে। কিন্তু আমাদের ভাবনাটা আরও বড় করতে হবে।

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য অনিয়ন্ত্রিত থাকার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:

সরবরাহ চেইনের সমস্যা: বাংলাদেশের বাজারগুলোতে প্রায়শই পণ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেমন পরিবহন সমস্যা, পণ্যের মজুদ সংকট ইত্যাদি। এর ফলে পণ্যের ঘাটতি তৈরি হয়, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব: পণ্য উৎপাদক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে বিভিন্ন স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীরা থাকে, যারা নিজেদের মুনাফা বাড়াতে পণ্যের মূল্য কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। এই কারণে বাজারে মূল্যবৃদ্ধি হয়। কৃষক কীভাবে সরাসরি বিপননের সাথে যুক্ত হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করা দরকার।

মূল্যস্ফীতি: অর্থনীতিতে যখন মুদ্রার মূল্য হ্রাস পায় এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন সাধারণভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে।

অপর্যাপ্ত বাজার মনিটরিং ও তদারকি: বাজারে সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব থাকলে ব্যবসায়ীরা সুযোগমত পণ্যের দাম বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে বাজার নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের মনিটরিং কখনোই কার্যকরভাবে কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব: বাংলাদেশ অনেক খাদ্যপণ্য ও কাঁচামাল আমদানি করে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, তখন তার প্রভাব দেশীয় বাজারেও পড়ে। বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই প্রভাব লক্ষণীয়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন অনেক কম। সেই তুলনায় বাংলাদেশে কমানো হয়নি। হলে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়তো।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বাংলাদেশ প্রায়শই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। এবার কয়েক দফার বন্যায় ফসলহানি হওয়ায় সবজি ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন ও বিপননে সংকট তৈরি হয়েছে।

মজুদদারি ও কৃত্রিম সংকট: কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মজুদদারি করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, যা বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।
দ্রব্যমূল্যের আলোচনায় সবসময়ই সিন্ডিকেটের কথা বলা হয়। কিন্তু সিন্ডিকেট জিনিসটা কি এবং এর সমাধান কি তা নিয়ে কাজ করা হয় না। ভোক্তা অধিকারের লোকজন বাজারে গেলে, মনিটরিং করলেই সমাধান আনা যাবে না। যতক্ষণ না সাপ্লাই চেইনে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা না যাবে ততক্ষণ সমস্যা থাকবে।