‘ভাই আমার নাম লেখেন, আজ ভাত খাওয়ার টাকাও নেই
ঢাকা জার্নাল: ‘ভাই আমার নাম লেখেন। কাল বেচা-কেনা হয়নি। আজ ভাত খাওয়ার টাকাও নেই। ওরা সব পুড়িয়ে দিয়েছে।’
সামান্য সাহায্যের আশায় এভাবেই কাতর মিনতি জানিয়ে নাম লেখার অনুরোধ জানান আব্দুল মজিদ। পল্টনে বইয়ের দোকানের সবটুকু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার।
সোমবার সকালে পল্টন মোড়ে পুড়ে ছাই হওয়া বইয়ের দোকানের সামনে কথা হচ্ছিল হাসানের সঙ্গে। এ সময় পাশের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মজিদ দৌড়ে এসে এভাবেই অনুরোধ জানাতে থাকেন।
‘হাসান বুক’ বইয়ের দোকানটি বাঁচাতে প্রাণন্ত চেষ্টা চালিয়েছেন হাসান। ‘কুরআন শরীফ রয়েছে, এগুলো পুড়াবেন না’ বলেও দোকানটি বাঁচাবার চেষ্টা করেন হেফাজতের আগুন থেকে। কিন্তু কিছুতেই শুনছে না হেফাজতের কর্মীরা। লাঠি দিয়ে হাসানের দুই পা ও শরীরে বিরাহীনভাবে আঘাত করে চলেছে। মার খেয়েও অনুরোধ করে যাচ্ছে সে। এরপরেও শেষ রক্ষা হয়নি। হেফাজতের কর্মীরা কুরআন শরীফসহ প্রায় ৫০ হাজার টাকার বই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।
হাসান বলেন, “ভাই ওরা কাফের, কুরআন শরীফের কথা বলেও রক্ষা পায়নি আমি। আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কুরআন শরীফেও।
সকালে শুধু আব্দুল মজিদ আর হাসান নয়, সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই হেফাজতের তা-বে নিজেদের অসাহায়ত্বের বর্ণনা দিতে থাকেন।
সব বই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ১৬ বছরের কিশোর জুয়েলেরও। বইয়ের দোকানের পাশাপাশি পান-বিড়ির দোকানটিও ছাই হয়ে গেছে তার। হেফাজতের আগুন থেকে অবশিষ্ট পড়ে রয়েছে ১০ থেকে ১২টি ভেজা বই। ফায়ার সর্ভিসের কর্মীরা পানি দিয়ে আগুন নেভানোর পর এগুলো অবশিষ্ট রয়েছে। কুরআন শরীফ’র পোড়া অংশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দোকানের সামনে।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানারএয়ারপুর গ্রামের বিধবা মা আনোয়ারা সংসার চলে এই কিশোর জুয়েলের আয়ের ওপর নির্ভর করে। সারা মাস যা আয় করে তা পাঠিয়ে দেয় মায়ের কাছে। তা দিয়েই চলে পুরো সংসারটি।
জুয়েল জানায়, ছোট ভাই সাইফুল ক্লাস ফোরে পড়ে আর বোন বৃষ্টি ক্লাস থ্রিতে। আরো একটি সাড়ে তিন বছরের ছোট বোন রয়েছে সংসারে। পিতা আব্দুল মালেকের মৃত্যুর পর পান-বিড়ির দোকান আর বইয়ের ছোট্ট এই দোনটির আয়েই পাঁচ বছর ধরে সংসার চালায় সে। এখন কি করবে জানে না সে। দুপুরে হয়তো কোন দোকানদারের কাছ থেকে টাকা নিয়েই চলতে হবে তাকে।
বই ব্যবসায়ী সেলিম জানান, কুরআন শরীফসহ অন্যন্য বইগুলো র্যাক থেকে ফেলে দিয়ে আগুন দিয়েছে হেফাজত কর্মীরা। দু-একটি কুনআন শরীফসহ কিছু বই ভেজা ও কাঁদা মাখা অবস্থায় সংরক্ষণ করেছেন তিনি।
একইভাবে মাসুন ইউসুফ, দেলওয়ারসহ সবারই বইয়ের দোকানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। ফরহাদ মনিসিংহ টাওয়ারের নিচের বইয়ের দোকান আর আশে পাশে আগুন জ্বালিয়ে যেন উল্লাস করেছে হেফাজতের কর্মীরা।
বইয়ের দোকানী উৎপল রায় জানালেন, তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। উল্লাসে বইয়ের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয় মনিসিংহ টাওয়ারে রাখা বইগুলোও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তারা। একই অভিযোগ করলেন হাদি খন্দকার, খোকন, সাগর, সুমনসহ আরো ১০জন।
সোমবার সকালে পল্টনের পুরাতন বইয়ের দোকানগুলোর ছাইয়ের স্তুপে পানি দিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সর্ভিসের কর্মীরা। সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ছাইয়ের স্তুপ। অপরদিকে ছোট ব্যবসায়ীদের কাপড়ের দোনগুলোও পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে।
আগুনে পোড়া আর ভাংচুরের দৃশ্য দেখে যে কেউ মনে করবে বড় কোন দুর্যোগ বয়ে গেছে এই এলাকা দিয়ে। ব্যাংক এশিয়া ভবনের ভাংচুর ছাড়াও আশে পাশে ভাংচুরের দৃশ্য যেন পুরানা পল্টনের চিরাচরিত চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
ঢাকা জার্নাল, মে ০৬, ২০১৩