Leadকর্পোরেট

পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

প্রায় প্রতিদিনই তৈরি পোশাক শিল্প খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-কে ঘোষণা দিতে হচ্ছে যে সব কারখানা খোলা থাকবে। কিন্তু সব কারখানা খোলা রাখা যাচ্ছে না। সরকার পতনের পর থেকে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে তা যেন থামছেই না পোশাক খাতে। শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে সোমবারও আশুলিয়ার অন্তত ৭৯টি কারখানার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে লাগাতার বিক্ষোভ করছেন। বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে সাভার,আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে এই অস্থিরতা বেশি। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন,অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন বিদেশি ক্রেতারা,দিচ্ছেন না নতুন অর্ডার।

সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানান শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলতেই হচ্ছে যে, তৈরি পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে একদিকে কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে,অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই অভিযোগ করছেন, রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা,ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে।

মালিকদের চিন্তা যথাসময়ে পণ্য শিপমেন্ট করা নিয়ে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে উৎপাদন শেষ করে শিপমেন্ট করতে না পারলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এয়ার শিপমেন্ট-এ যেতে হবে। এতে করে খরচ বাড়বে কয়েক গুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান অস্থিরতা দমন করতে না পারলে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।

এর মধ্যেই খবর বেরিয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারতভিত্তিক বহুজাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড রেমন্ড। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে পোশাক উৎপাদনের বড় একটি অংশ ভারতে চলে যেতে পারে বলে মনে করেন রেমন্ডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক গৌতম সিংহানিয়া। ভারতের সংবাদপত্র দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি একথা বলেছেন। গৌতম সিংহানিয়া বলেছেন,‘আমরা বাংলাদেশে কাপড় বিক্রি করি। সাম্প্রতিক সংকটের পর সেই সব ব্যবসা এখানে ফিরে আসছে। একবার ব্যবসা এখানে স্থানান্তরিত হলে তা আর ফিরে যাবে না’। তিনি আরও বলেন,‘তাদের (বাংলাদেশের)কাপড়ের সরবরাহ নেই। আমাদের এখানে (ভারতে) কাপড় এবং তৈরি পোশাকশিল্পের ভিত্তি আছে। এখন বল ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এটা ধরতে হবে’।

সমস্যা তৈরি হয়েছে চেইন অব কমান্ডে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এবারের বিশৃঙ্খলা থামাতে পারেনি। ফলে বিষয়টা ছড়িয়ে গেছে। আগে এই ধরনের সমস্যা হলে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনে স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে সমস্যার সমাধান করা হতো। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ মানুষগুলোও সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। শ্রমিক নেতারা বুঝে উঠতে পারছে না কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

প্রথমে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নামেন শ্রমিকরা। পরে তারা চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দাবি জানান। এই দাবি বাস্তবায়িত হলে অনেক নারী কর্মী বেকার হবেন এবং নতুন করে তারা চাকরিও পাবেন না। তারা বুঝতেও পারছেন না যে, মেয়েদের হাতের টেইলারিং কাজ পুরুষরা করতে পারবেন না। পাশাপাশি শ্রমিকরা বেকারদের জন্য চাকরি ও কর্মচ্যুতদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি তোলেন। হঠাৎ করে এ ধরনের দাবি উঠায় বিব্রত পোশাক খাতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় শ্রমিক নেতারাও। শ্রমিক নেতা ও মালিকপক্ষ মনে করছেন,যে ধরনের দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে তা সব পূরণযোগ্য নয়। কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও। গত সাড়ে ১৫ বছরসহ অতীতেও পোশাক খাতে মজুরি ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হয়নি। এখন মজুরির বাইরে কর্মীদের মধ্যে নারী পুরুষের সমতা আনার আন্দোলন প্রমাণ করে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।

পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, তবে পুরোপুরি নয়। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অস্থিরতা পোশাক রপ্তানিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উৎপাদনে দেরি হওয়ায় অনেক উৎপাদককে ছাড় দিতে হবে। ব্যয়বহুল এয়ার শিপমেন্টের পাশাপাশি ওয়ার্ক অর্ডার চলে যাওয়ার চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে। বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো যদি সময়মতো পণ্য হাতে না পায় তাহলে তারা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ছাড় ও বিমানে পণ্য পাঠানোর দাবি করবে যা সব রপ্তানিকারকের পক্ষে করা সম্ভব হবে না।

সবাই বুঝতে পারছে যে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ নিয়ে এই খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিও ক্ষতির মুখে পড়বে।