শিক্ষা-সংস্কৃতি

কলেজের সম্পত্তি সভাপতিকে লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ

সরকারি শামসুল রহমান কলেজের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি হস্তান্তরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও প্রায় দুই একর ৪৭ শতাংশ জমি গভর্নিং বডির সাবেক সভাপতির নামে লিখে দিয়েছেন অধ্যক্ষ। শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই কলেজের জমিতে অধ্যক্ষের বাসভবন, শিক্ষকদের আবাসন ও ছাত্রী হোস্টেল ছিল, যা দখল করে নিয়েছেন সাবেক সভাপতি।

শুধু তা-ই নয়, এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদন এবং বরিশাল অঞ্চলের উপরিচালকের নেতৃত্বে গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ ঘটনার প্রমাণ মিলেছে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞন বিষয়ের বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কলেজ সরকারি ঘোষণার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ অবস্থায় কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মৌজে আলী গভর্নিং বডির তৎকালীন সভাপতি শামসুর রহমান ও তার ছেলেকে এওয়াজ বদলের নামে দুই একর ৪৭ শতাংশ জমি লিখে দেন। এ ঘটনায় একাধিক তদন্ত হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা কলেজ কার্যক্রমের ওপর সব রকম নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শুধু দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বরিশাল অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এ ঘটনায় অধিদফতরের মহাপরিচলক বরাবর ২০১৬ সালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ওই প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, শামসুর রহমান কলেজ সরকারি ঘোষণার পর ২০১৬ সালের ৩০ জুন কলেজটির নিয়োগ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন অধ্যক্ষ মো. মৌজে আলী হাওলাদারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মে দেখা যায়, তিনি সরকারি নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল গভর্নিং বডির অনুমোদনক্রমে প্রায় দুই বছর চুক্তিভিত্তিক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ গভর্নিং বডির সিদ্ধান্তে দেখা যায়— মো. মৌজে আলী হাওলাদার কলেজ তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন, যা বিধিসম্মত হয়নি। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের শিক্ষা পরিদর্শক ভবেন্দ্র নাথ বাড়ৈর ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিলের তদন্ত প্রতিবেদনেও বিধিবহির্ভূত অর্থ উত্তোলনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া, অধ্যক্ষ মো. মৌজে আলী হাওলাদার প্রতিমাসে এমপিও বাবদ বেতন-ভাতা প্রাপ্তি ছাড়াও তাকে প্রতিমাসে অতিরিক্ত ৪৫ হাজার টাকা কলেজে থেকে দেওয়া হয়েছে, যা গভর্নিং বডির ক্ষমতার অপব্যবহার। জাতীয়করণ ঘোষণার প্রাক্কালে অতিরিক্ত এ অর্থ দেওয়ার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের ১ জুলাই শামসুর রহমান কলেজটি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে ‘ইদিলপুর মহাবিদ্যালয়’ নামে দুই দশমিক ৪ একর জমি এবং ছোট্ট একটি দ্বিতল ভবন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। নতুন কলেজটিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে ১৯৯৩ সালে আলহাজ শামসুর রহমান এককালীন ১৫ লাখ টাকা জমা দেন এবং ইদিলপুর মহাবিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘শামসুর রহমান কলেজ’ নামকরণ করা হয়।

সাবেক অধ্যক্ষের দুর্নীতি
অভিযোগে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর যোগদানের পর থেকে নিয়মিত কলেজে উপস্থিত থাকতেন না অধ্যক্ষ মো. মৌজে আলী হাওলাদার। সপ্তাহে দুই-একদিন এবং মাসে চার দিন উপস্থিত থাকতেন তিনি। এটা গোপন করার জন্য তিনি কখনও শিক্ষক হাজিরা খাতায় সই করতেন না। এভাবে বছরের পর বছর অনিয়মিত থেকেও প্রতি মাসে বেতনভাতাদি নিতেন। অধ্যক্ষ তার নিজের বাড়ি করার জন্য বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ কলেজ ফান্ড থেকে চেকের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছেন।

সরকারি বেতন-ভাতার অংশ বাদে অধ্যক্ষ প্রতিমাসে ৩০ হাজার করে মোট ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়েছেন। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের এমপিওর টাকা বাদে প্রতি মাসে ৪৫ হাজার করে মোট ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা নিয়েছেন।

২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর তার চাকরির মেয়াদ শেষ অর্থাৎ ৬০ বছর পূর্ণ হয়। এরপর সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে গভর্নিং বডির মাধ্যমে অবৈধভাবে পুনরায় নিয়োগ নিয়ে পাঁচ মাস পর অসুস্থ হয়ে অবসর যান। এরপর পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত চাকরি না করেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের মাধ্যমে তিনি কলেজ ফান্ড থেকে প্রতি মাসে বেদন বাবদ ৪৫ হাজার করে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন।

গভর্নিং বডির দুর্নীতি
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ৩০ জুন ওই কলেজে নিয়োগ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই বছরের ২৪ আগস্ট দাসের জঙ্গল মৌজার ১৭৫ এবং এসএ ২০২ নম্বর খতিয়ানের ৪৭ নম্বর দাগের ৩.০৫ একর জমি এবং এসএ ৪৬ নম্বর দাগের মোট ২ একর ৪৭ শতাংশ হস্তান্তর করে। যদিও সেসময় ওই জমির ওপরে বাংলালিংক টাওয়ার, অধ্যক্ষের দুই তলা ভবন, কলেজ শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার এবং ছাত্রী হোস্টেল ছিল। ওই জমি এবং আবাসনগুলো কলেজের নিজম্ব সম্পত্তি হলেও অধ্যক্ষকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধার দিয়ে গভর্নিং বডির সভাপতি শামসুর রহমান ও তার ছেলের নামে তা লিখে নেওয়া হয়।

প্রভাষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যক্ষ এওয়াজ বিনিময়ের নামে নাটক সাজিয়ে সম্পত্তিগুলো তাদের নামে বিধিবহির্ভূতভাবে লিখে দেওয়া হয়, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। আবাসিক কোয়ার্টারে কলেজের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রীদের হোস্টেল থেকে বের করে সম্পত্তিগুলো দখল নিয়েছেন সাবেক সভাপতি। সেই সঙ্গে বাংলালিংক টাওয়ার বাবদ অপারেটরটির সঙ্গে কলেজের চুক্তির সমুদয় টাকা তার ছেলের অনুকূলে হস্তান্তর করতে বাধ্য করেন। পরবর্তীকালে টাওয়ারসহ জমিগুলো দখলে নেন সভাপতি।

প্রতিবাদ করায় প্রভাষককে বরখাস্ত
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে— শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে জমি হস্তান্তরের প্রতিবাদ করায় ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক সাইফুল ইসলামকে প্রথমে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। পরে ২০১৭ সালের ৩১ মে তাকে চূড়ান্ত বরখাস্ত করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জাতীয়করণের জন্য পরিদর্শনকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের নামের তালিকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে। গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ২০১৯ সালের ১৫ মে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী আত্মীকরণের লক্ষ্য পূরণ করা নির্ধারিত ছকে প্রভাষক সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও অভিযুক্তদের বক্তব্য
সম্পত্তি হস্তান্তর ও প্রভাষককে বরখাস্ত করার ঘটনায় দুই দফা তদন্তের পর আবারও তদন্ত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ঢাকার আঞ্চলিক উপপরিচালক সাহারা খানম। জানতে চাইলে  তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে। ফলে সবকিছু এখন মনে নেই।’

কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ফজলুল হক  বলেন, ‘কলেজটি যখন বেসরকারি ছিল, তখন ওই সময়ের অধ্যক্ষ থাকালে জমি এওয়াজ বদল হয়েছে। এখন কলেজটি সরকারি।’

তৎকালীন সভাপতি শামসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে কলেজ থেকে জানানো হয়, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত, চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে আছেন।

অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মো. মৌজে আলীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।