শিক্ষা-সংস্কৃতি

‘স্বাস্থ্য ভালো’ শিক্ষার্থীর পোশাকের জন্য গুণতে হচ্ছে অতিরিক্তি টাকা!

কারও শারীরিক গঠন বা অবয়বকে উপহাস করা বা উপহাস করার মতো কিছু কাজ করা বডি শেমিং; যা বিভিন্ন দেশে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এধরনের অপরাধে জেল-জরিমানার বিধান আছে। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এর চর্চা উদ্বেগজনক পর্যায়ে। সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের জারিপে বলা হয়েছে, শতকরা ৬৯ দশমিক ৯২ তরুণী বডি শেমিং-এর শিকার হয়েছেন। এই সংকট থেকে পরিত্রাণে সচেতনতা বাড়ানোর ওপরে জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। এর উল্টোটাও ঘটছে।

গতবছর মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির যোগ্যতার শর্তে লেখা হয়- শিশুদের ওজন বেশি হলে ভর্তি নেওয়া হবে না। যা নিয়ে তুমুল হইচই সৃষ্টি হয়। যোগ্যতার শর্তে জানানো হয়, যারা প্লে-গ্রুপে ভর্তি হবে তাদের উচ্চতা হতে হবে ৩ ফুট থেকে ৩ ফুট ৮ ইঞ্চির মধ্যে এবং তাদের ওজন হতে হবে ১৩ থেকে ২১ কেজির মধ্যে। আর এই ওজন বেঁধে দেওয়া নিয়েই শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে তা প্রত্যাহার করা হয়।

এবার শিক্ষার্থীদের ‘স্বাস্থ্য ভালো’ (ওজন বেশি) হলে তাদের পোশাকের জন্য বাড়তি ৪শ টাকা দেওয়ার কথা বলেছে রাজধানীর একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের বিরুদ্ধে সম্প্রতি এমন অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের শর্ত বা শব্দ প্রয়োগ স্পষ্টতই ‘বডি শেমিং’ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এধরনের শর্ত ও বক্তব্য হানিকর।

শনিবার (৪ জুন) ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি, অর্থিক অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করেও নিম্নমানের ড্রেস কেনার অভিযোগে রাজধানীর ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। তারা জানান, জুতাসহ স্কুল ড্রেসের দাম বেশি নিয়ে নিম্নমানের পোশাক ও জুতা সরবরাহ করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে স্কুল ড্রেস নষ্ট হয়ে গেছে। ড্রেসের কাপড়ের জন্য ছাত্রদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৮০০ ও ছাত্রীদের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। আর শিক্ষার্থীদের ‘স্বাস্থ্য ভালো’ হলে অতিরিক্ত ৪০০ টাকা নেওয়া হয় বলেও জানান তারা।

‘এমন সিদ্ধান্ত সংবিধানের বিপরীতে যাচ্ছে’, উল্লেখ করে সাহিত্যিক ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, এধরনের যেকোনও অবস্থান সভ্যতার রীতিনীতির বিরুদ্ধে এবং ক্ষমাহীন অপরাধ। যেকোনও অভিভাবক স্কুল কর্তৃপক্ষকে আদালতে নিতে পারেন। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করি এবং মনে করি এই স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত শিশুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এই আদেশ তুলে নেওয়া। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। এর মধ্যে এধরনের অপচর্চা থাকতে পারে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করুক এবং ঘটনা সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যাতে করে আগামীতে এরকম কোনও স্কুল না করে। এটা সংবেদনশীল বিষয়।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এধরনের বডি শেমিংয়ের শিকার স্কুলে নানাভাবেই হতে হয়। কিন্তু যখন এটা অফিশিয়ালি বলা হয় তখন বুঝতে হবে আসলে তারা বিষয়টিকে অ্যাড্রেসই করতে জানেন না। শিক্ষকরা যদি এতটুকু সংবেদনশীলতা না দেখাতে পারেন তাহলে আসলে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, এধরনের সিদ্ধান্ত যখন শিশু শোনে তখন তার মনোজগতের ওপর দুই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। একটা তাৎক্ষণিক, আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। তাৎক্ষণিক প্রভাবে তার মন খারাপ হবে, সে অমনোযোগী হবে, মেজাজ খারাপ হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে এই বডি শেমিংয়ের কারণে তার ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন হতে পারে যা তার চিন্তা, আবেগ ও আচরণকে অস্বাভাবিক করে তুলতে পারে।

মনের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী তৌহিদা শিরোপা মনে করেন বডি শেমিংয়ের কারণে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে বা এ ধরনের কোনও ঘটনায় আত্মবিশ্বাসের অভাব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি পরিণত বয়সেও তার রেশ থেকে যেতে পারে। আরেকটি বড় প্রভাব পড়ে তার খাদ্যাভাসে। অনেকেরই ইটিং ডিজঅর্ডার দেখা দেয়, এক ধরনের আতঙ্ক বা ফোবিয়া কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, বডি শেমিং-এর কারণে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো- ছেলে-মেয়েদের মধ্যে নিজের ক্ষতি করা বা আত্মহত্যার প্রবণতা হতে পারে। কেননা, অন্যের নেতিবাচক সমালোচনা শুনে নিজে যেমন তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারে না। নিজের শরীরকে ভালো লাগে না। কম খাওয়া বা না খাওয়ার প্রবণতা থেকে পুষ্টিহীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে আমরা যখন কথা বলবো, আচরণ করবো, তখন সচেতনভাবেই খেয়াল রাখতে হবে, যেন আমরা শিশুদের মানসিক ক্ষতি না করে ফেলি। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন