Leadমত-অমতসব সংবাদ

যারা সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর প্রেসক্রিপশন দেয়

যারা সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলো; তারা এখন বেশিরভাগই সেকেন্ড হোমে থাকে। তাদের শেখানো বিদ্বেষের বুলি নিয়ে এখন বাজারে সক্রিয় যারা; তারা অনেকেই কেবল রবাহুত; ‘ঘৃণা বিক্রি করে’ তার পরিবর্তে দুর্নীতির একচ্ছত্র-আধিপত্য বিস্তারের কৌশলে এখন আর বিশেষ কাজ হবে বলে মনে হয় না।

বিপিএল-এর আসরে বলিউডের তারকা সালমান খান, ক্যাটরিনা কাইফসহ ভারতীয় সংগীত শিল্পীদের উপস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক তিক্ত কথার পসরা সাজাতে দেখলাম অনেককে।

একটি বিষয় আলোচনার শুরুতেই বলে নেয়া প্রয়োজন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রশাসন, নীতি-নির্ধারক আর সামরিকবাহিনী মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটায়। এর সঙ্গে দেশগুলোর সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক থাকে না। আর প্রতিটি দেশের অভিনয় শিল্পী, সংগীত শিল্পী, লেখক-কবি, ক্রীড়াবিদ সত্য-সুন্দর-মঙ্গলের আরাধনা করেন। শিল্পের কোন ভূগোল থাকে না-থাকে না মানচিত্র। শিল্পী সতত মানুষকে কাছে আনার চেষ্টা করে।

যারা কট্টর ধর্ম-পন্থী ও উগ্র-জাতীয়তাবাদী; তাদের কাজ করে খাওয়ার সামর্থ্য না থাকায়; ঘৃণা বিক্রি করে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-অধুনা সেকেন্ড হোমের ব্যবস্থা করতে হয়। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপ আউট-কিছু সিলেবাসের বাইরের বই পড়ে অতি-আত্মবিশ্বাসী লোকজন বেশ পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বলেন, আমরা রাজনীতির সঙ্গে সব কিছু মিশাই। সংগীত-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা-ক্রিকেট সব কিছুর সঙ্গে ক্রমাগত রাজনীতি মেশাতে মেশাতে আজ বাংলাদেশের শিল্পজগত এর সোনালি অতীত হারিয়ে এক পোড়োবাড়ির বেদনা হয়ে বেঁচে আছে। এ থেকে উত্তরণের চেষ্টাও থেমে নেই; কারণ কোন দেশের শিল্পজগতের মানুষ হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।

যারা সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলো; তারা এখন বেশিরভাগই সেকেন্ড হোমে থাকে। তাদের শেখানো বিদ্বেষের বুলি নিয়ে এখন বাজারে সক্রিয় যারা; তারা অনেকেই কেবল রবাহুত; ‘ঘৃণা বিক্রি করে’ তার পরিবর্তে দুর্নীতির একচ্ছত্র-আধিপত্য বিস্তারের কৌশলে এখন আর বিশেষ কাজ হবে বলে মনে হয় না।

এই গোটা বিশ্বের শিল্প-সংগীতের যে ভান্ডার; তা এখন অনলাইনে থরে থরে সাজানো; ক্লিক দূরত্বে এই আনন্দময় জগত। সেখানে কোন অলীক বিভাজনের গান ঘৃণাজীবীরা গেয়ে চলেন; তা বোধগম্য নয়। শিল্প-সাহিত্য-সংগীতের বিশ্বায়ন এক অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা। নানা দেশের শিল্পের নদী; শিল্প-সাগরে সম্মিলিত হবে; এ হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম।

এই দক্ষিণ এশিয়াতে যখন কট্টর হিন্দু ও কট্টর মুসলমান রাজা-বাদশাহরা তাদের পালিত ঘৃণাবিদ আর খুনে সেনাদের নিয়ে ‘মানুষ’-এর আত্মা ছিঁড়েখুড়ে আদিম উল্লাসে মেতেছে; তখন বাউল ও সূফিগানের শান্তিদূতেরা নদীপথে নৌকায় করে জনপদ থেকে জনপদে গেয়ে বেড়িয়েছেন, মানুষের মুক্তির গান। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার সংগীত জগতের একটি অখণ্ড সুরের বন্ধন অনেক আগেই গড়ে উঠেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন দেশের গানে মানুষ তার নিজের জনপদের সংগীতের সুর ও অন্যভাষায় একই বাণীর অনুরণন খুঁজে পায়। রাজনীতির ছোরার খোঁচায় অগণন মানুষের মৃত্যু ঘটলেও শিল্প-সংগীতের হৃদপিন্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে অক্ষম খুনে রাজনীতির ত্রিশূল বা তরবারি।

পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যা আপনাকে আপনার পছন্দের গান শোনা থেকে, অভিনয় দেখা থেকে কিংবা সাহিত্য পড়া থেকে দূরে রাখতে পারে। আর এই জগতটি ‘পেয়াজ-বানিজ্য’ নয়; যে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক প্রশাসনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে এর জোগান। শিল্প-সাহিত্য হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার মুক্তাঞ্চল। সংগীতের ভিসা-পাসপোর্ট লাগে না এক দেশ থেকে আরেক দেশের সীমান্ত অতিক্রমে।
শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে ‘সংরক্ষণবাদ’ দিয়ে জনমন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মানুষের অন্তর্গত ভালোলাগাকে নিয়ন্ত্রণ করবে; এটা কার সাধ্য।
এতোকাল রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম চেষ্টা করেছে, তার মন পছন্দ রাজনীতি ও ইতিহাসের বয়ান সাধারণ মানুষের মনে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দিতে। সরকারের স্তুতি প্রিয় কট্টরপন্থী হিন্দু, কট্টরপন্থী মুসলমান, উগ্র জাতীয়তাবাদী কিংবা ডগমেটিক সেক্যুলার সমাজ ‘আইদার ইউ আর উইদ মি অর এগেইন্সট মি’ টাইপের বিভাজন-বানিজ্য চালিয়েছে।
এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বানোয়াট ইতিহাসের ন্যারেটিভ। সাধারণ মানুষের ‘কথা’ এতোকালের ইতিহাস-রাজনীতির বয়ানে অনুপস্থিত।
ইন্টারনেট মাধ্যম সেই সাধারণ মানুষের ‘কথা’ রাজনীতি ও ইতিহাসের ন্যারেটিভে যুক্ত করে দিয়েছে অনায়াসে।
ফলে আপনার বাড়ির পাশের রাজনীতি-ব্যবসার মিডলম্যান আবুল বা বাতেন যদি এখন রাগে উন্মত্ত হয়ে বলে, আমরা সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মেশাই’; সে কথা পাগলের প্রলাপের মতো শোনাবে।

রাজনীতির সঙ্গে সংগীত-চলচ্চিত্র-ক্রিকেট মিশিয়ে রীতিমত স্বভাবসুলভ ‘লা গোবরিনা ফেস্ট’ চালিয়েছে ডগম্যাটিক সেক্যুলার আর অর্থোডক্স হিন্দু-মুসলমান। তাতে কিন্তু থেমে থাকেনি শিল্প-সংগীতের মেঘের ডানায় উড্ডয়ন। মানুষের মনের মধ্যে শিল্প-সংগীতের এক চৌম্বক আকর্ষণ থাকে। আপনি কোন ভূগোলে বসে গান গাইছেন, শ্রোতার জন্য সেটা এতটুকু বিবেচনার নয়; গানটা শুনতে ভালো লাগছে কীনা সেটাই আসল কথা।

কাজেই ধর্ম-রাজনীতির ‘চর দখলের’ সান্ত্রী-সেপাইদের সবকিছুর সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে করে খাওয়ার যে অপকৌশল; তাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়া অনুচিত। রাজনৈতিক প্রশাসন-নীতি নির্ধারক-সামরিক বাহিনীর প্রতি জনমানুষের যে নেতি ও অপছন্দ; তা থেকে দূরে রাখতে হবে সঙ্গীত-চলচ্চিত্র-সাহিত্য-চিত্রকলা-ক্রীড়া এরকম সৃজনশীল আনন্দময় জগতটিকে।

শিল্পীর একমাত্র পরিচয়; সে মানুষ; তার শিল্প-সাধনা যাপিত জীবনের ক্লেশ থেকে মানুষের মুক্তির অন্বেষণ।