বন্যায় ডুববে ঢাকা
ঢাকা জার্নাল:ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবকটি জেলা প্লাবিত হয়েছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে দেশের নতুন নতুন এলাকা। ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতেও পানি বৃষ্টি পাচ্ছে। এতে রাজধানী ঢাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই সিটি করপোরেশনসহ অন্য সেবা সংস্থাগুলোর কোনও প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সোমবার (১৪ আগস্ট) বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে রাজধানীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এ সময় তিনি আশঙ্কা করে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দেশের ২০ জেলার ৫৬ উপজেলা বন্যাকবলিত। এতে সারা দেশে মারা গেছেন ২০ জন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৬ লাখ মানুষ। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি মধ্যাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে নেমে যাবে। তবে নামার সময় ঢাকার নিম্নাঞ্চলসহ আরও ৯টি জেলায় বন্যা হতে পারে।’
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উজানের তিনটি অববাহিকায় (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধির হার গড়ে ৪৭ সে. মি.। নদীতে অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতিশীল রয়েছে এবং এই বন্যা পরিস্থিতি মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। ঢাকার চারদিকে ৫টি নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সে.মি. থেকে ১৫০ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
এবছর উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে স্মরণকালের মারাত্মক বন্যা হয়েছে। এসব দেশের বন্যার পানি ক্রমশ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে নামছে। এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রায় সবকটি জেলা কয়েক ফুট পানি প্লাবিত হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুল হোসেন বলেন, ‘তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীসহ ঢাকার আশপাশের ৫টি নদীর পানি ৬০ সেন্টিমিটারের নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রতিদিন পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আগামী তিন দিনের মধ্যে ঢাকা বন্যাপ্লাবিত আশঙ্কা নেই। যদি এর মধ্যে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঢাকা বন্যা থেকে মুক্তি পাবে। না হয় আক্রান্ত হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা অঞ্চলকে ঘিরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীসহ ৫টি নদী রয়েছে। দিনদিন দখল আর ভরাটের কারণে খালগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এই নদীগুলোতে পানি বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার মূল ভূ-খণ্ডে চাপ বাড়বে। এছাড়া নগরীতে একটু ভারী বর্ষণ হলেই তীব্র জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে ঢাকার ভেতরের পানি মিলিত হয়ে ভয়াবহ বন্যায় রূপ নিতে পারে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন সোমবার বলেন, ‘যেকোনও দুর্যোগ আমরা সমন্বিতভাবে মোকাবিলা করব। বন্যা মোকাবিলা করতে আমরা প্রস্তুতি শুরু করেছি।’ তবে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিস্তারিত বলতে হলে আরও দু’দিন অপেক্ষা করতে হবে।’
বন্যা পরিস্থিতি পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসবাহুল ইসলামকে ফোনে পাওয়া যায়নি। মেয়র আনিসুল হক রয়েছেন দেশের বাইরে। তবে সংস্থার ঊর্ধ্বতন দু’জন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মেয়র দেশের বাইরে আছেন। বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে এখনও আমাদের কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। হয়তো পরিস্থিতি খারাপ হলে তখন একটা সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
শুধু দুই সিটি করপোরেশন নয়, ঢাকাবাসীর সেবাদানকারী অন্যান্য সংস্থাগুলোরও নেই কোনও প্রস্তুতি। ঢাকায় বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হলেও কোনও সংস্থাই এখন পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না।
রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলগুলোর মধ্যে বালু নদী ও শীতলক্ষ্যার আশপাশ, নাসিরাবাদের বালুপাড়া, গৌরনগরের পশ্চিম পাড়া, পূর্বপাড়া, ফকিরখালী, ঈদেরকান্দি, কাঁশিয়াখালী, মাতুয়াইল, ডেমরা, ডিএনডি বাঁধ, আমুলিয়া, বাসাব, নন্দীপাড়া, মাদারট, বেরাইদ, যাত্রাবাড়ীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্বাংশ বাঁধ এলাকা দনিয়া, কাজলা, শনির আখড়া, বাকেরপাট, রায়েরবাগ, মিরাজনগর, মোহাম্মদবাগ, সাঁতারকুল অন্যতম। সামান্য বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় বন্যার পানি দেখা দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, বিগত সময়ে দেশে যেসব বন্যা হয়েছে তার মধ্যে ১৯৯৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালের বন্যায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাও প্লাবিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর ঢাকা রক্ষাবাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে আর কোনও বন্যার পানি ঢাকায় ঢুকতে পারেনি। তবে সংস্কারের অভাবে বাঁধের ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। পুরো বাঁধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই রক্ষাবাঁধ ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নির্মাণ করা হয়নি। যে কারণে উত্তরাঞ্চল থেকে ধেয়ে আসা বন্যার পানি ঢাকার পূর্বাঞ্চল দিয়ে ঢুকে পড়ে নগর প্লাবিত করতে পারে।
এ অবস্থায় আগের মতো পরিস্থিতি হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি হবে। কারণ তখন কার সময়ের চেয়ে এখন ঢাকায় যেমন ঘনবসতি বেড়েছে, তেমনি জনসংখ্যা ও অবকাঠামোগত নানা প্রতিবন্ধকতাও বেড়েছে। ফলে পানি দ্রুত সরতে পারবে না। তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। সৌজন্যে: বাংলা ট্রিবিউন।
ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১৪, ২০১৭।