শিক্ষা প্রকল্প, অপচয় যজ্ঞের আয়োজন ৪৪ কোটি টাকার
ঢাকা জার্নাল : সরকারি ক্রয় নীতি (পিপিআর) লংঘন করে শিক্ষা প্রকল্পের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ৪৪ কোটি টাকা অপচয় মহাযজ্ঞের আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে বাছাই করা তিন প্রাতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার হঠকারি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ)।
তবে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কথা জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মাহামুদ উল হক। তিনি বলেন, বাছাই করা তিন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়নি, বিশ্বব্যাংক চায়না বলে। বিশ্বব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানকে অযোগ্য বিবেচনা করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সেকায়েপ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষক সংকটে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মানসম্মত অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের উপ-বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কাজ করা হয়ে থাকে। ২০১৭ সালে প্রকল্পের বর্তমান পর্যায় শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ইংরেজি এবং বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়। এরমধ্যে ইংরেজির জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল, গণিতের জন্য ফিলিপাইনের মেডিকোর ক্যারিয়ার সিস্টেমস ইনকর্পোরেট (এমসিএস) এবং বিজ্ঞানের জন্য বাংলাদেশের এনভায়রনমেন্ট, এগ্রিকালচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (ইএডিএস)-কে বাছাই করা হয়। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১৪ সালের শুরুর দিকে।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রুপে ছয়টি করে প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এই তিনটিকে নির্বাচন করে তালিকা বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় প্রায় এক বছর আগে। এরমধ্যেই প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হওয়ায় নতুন প্রকল্প পরিচালক এ তালিকা অগ্রাহ্য করেন।
নতুন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব নিয়েই প্রকল্পের কার্যক্রম তদারকির জন্য ওলিউল ইসলাম নামে একজনকে কোয়ালিটি এস্যুরেন্স কনসালট্যান্ট পদে উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেন। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পরামর্শক পদে লিয়েনে কর্মরত উপসচিব শরীফ মাসুদের পরামর্শে নির্বাচিত তিন প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন।
কিন্তু দরপত্রে অংশ না নেওয়ায় বা আগ্রহ প্রকাশ না করায় ব্র্যাককে কাজ দিতে সমস্যা দেখা দেয়। সর্বশেষ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে কাজটি ব্র্যাককে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়াও হয়।
যদিও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’র মাধ্যমে প্রায় ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বর্তমানে একটি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
ওলিউল ইসলাম এবং উপসচিব শরীফ মাসুদ এ দুই কর্মকর্তার পরামর্শে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রকল্প পরিচালক স্টিয়ারিং কমিটিকে দিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং কার্যক্রমে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করান।
তবে দরপত্র ছাড়া এ প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার বেশি অংকের কার্যাদেশ দেওয়ার সুযোগ না থাকায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়।
প্রকল্পের বিভিন্ন বৈঠকের কার্যপত্র এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, স্টিয়ারিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন (ডিআরএইচ) কর্মসূচি সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্সসূচি এবং বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন প্রকল্পকে একিভূত করতে নতুন করে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
যদিও পিপিআর অনুযায়ী, শুধুমাত্র একই ধরণের কাজের ক্ষেত্রে এ ধরণের কর্মসূচিতে সংশোধন আনা যায় এবং তাও মোট বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যায়।
অন্যদিকে বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন ও অতিরিক্ত শ্রেণি শিক্ষক প্রশিক্ষণ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কাজ। এক্ষেত্রে বইপড়ার অভ্যাস উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়ার উদ্যোগ পিপিআর লংঘন এবং সরকারি অর্থের অপচয় বলে দাবি প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।
তাছাড়া শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কোন অভিজ্ঞতাও নেই।ফলে অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই তাদের কাজটি করাতে হবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সমালোচনার থেকে রক্ষা পেতে এ সুযোগ নিচ্ছেন প্রকল্প কর্মকর্তা।
পিপিআর-এর বিধান অনুযায়ী, সার্ভিস প্যাকেজ বাতিল বা সংশোধিত প্যাকেজ অনুমোদন না করে বিকল্প পন্থায় কোন কাজ সম্পন্ন করার, আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়া স্থানীয়ভাবে ক্রয় প্যাকেজে অন্তর্ভূক্ত কোন ক্রয় পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং ক্রয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) বা আরডিপিপি সংশোধন পিপিআর লংঘন।আর এতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া অর্থের ৪৪ কোটি টাকা অপচয় বা আত্মসাৎ হবে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে কোনো কাজ দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মাহামুদ উল হক বাংলানিউজকে বলেন, বলেন, নতুন করে ভাবা হচ্ছে। এখন আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে দেওয়া হবে না। সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউটকে দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
ঢাকা জার্নাল, এপ্রিল ২১, ২০১৬