২৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে মীর কাসেমের আপিল মামলা
ঢাকা জার্নাল: আপিল বিভাগে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ হতে পারে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল মামলার বিচারিক কার্যক্রম।
এমনটাই আশা প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে এক প্রশ্নের জবাবে এ আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামিপক্ষ যুক্তিতর্কের প্রাথমিক বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেছেন। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি আমি রাষ্ট্রপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করবো। এর পর আসামিপক্ষ একঘণ্টা সময় পাবেন আমাদের বক্তব্যের উত্তর দেওয়ার জন্য। আশা করছি, ২৩/২৪ ফেব্রূয়ারির মধ্যে মীর কাসেমের আপিল মামলাটি শেষ হয়ে যাবে। এরপর রায়ের জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
যুক্তি উপস্থাপন শেষে আদালত থেকে বের হয়ে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামের ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। তার অপরাধ দেখানো হয়েছে ৭ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ মীর কাসেম আলী ৭ নভেম্বর ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সম্পাদক হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সুতরাং তিনি ডালিম হোটেলসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ওইসব অপরাধের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও বলেননি যে, মীর কাসেম আলীর আলবদরের কমান্ডার ছিলেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের দিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছে। আর হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে তারাই জড়িত ছিলো। ওই সময়কার ছাত্রসংঘের নেতাদের ইতোমধ্যে ফাঁসিও হয়েছে। এমনকি কাদের মোল্লার মতো কর্মীদেরও ফাঁসি হয়েছে। অথচ তিনি (মীর কাসেম আলী) সম্পাদক থেকে নিষ্কলুষ থেকে যাবেন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
২৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষে কি বক্তব্য উপস্থাপন করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি প্রমাণ করতে চেষ্টা করবো ডালিম হোটেলের অত্যাচারের সঙ্গে মীর কাসেম আলীর সম্পৃক্ততা।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের এক নম্বর বেঞ্চে এ শুনানি চলছে। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
গত ০৯ ফেব্রুয়ারি থেকে চলছে মীর কাসেমের আপিল মামলাটির শুনানি। ওইদিন এবং পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায় এবং সাক্ষীদের অভিযোগভিত্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন শেষে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন এস এম শাহজাহান। বুধবার শুনানির ৫ম দিনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন তিনি।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছিলো। এর মধ্যে ১০টিতে জামায়াতের এ নেতা দোষী সাব্যস্ত হন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩০ নভেম্বর মীর কাসেম আলী আপিল করেন। মীর কাসেম তার দেড়শ’ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ১ হাজার ৭৫০ পৃষ্ঠার আপিলে মোট ১৬৮টি কারণ দেখিয়ে ফাঁসির আদেশ বাতিল করে খালাস চেয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী। এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। বাকি ৪টি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।
১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ মোট ৮ জনকে হত্যার দায়ে কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে ও ১২ নম্বর অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দেন বিচারপতিরা।
ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে প্রমাণিত ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে (২ নম্বর অভিযোগ) ২০ বছর ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের (১৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এছাড়া অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
প্রমাণিত না হওয়া ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগে খালাস পান মীর কাসেম আলী। এগুলো ছিল অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ।
মীর কাসেম আলীর মামলাটির মাধ্যমে সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি চলছে ৭ম আপিল মামলার।
এর আগে ঘোষিত ছয়টি আপিল মামলার চূড়ান্ত রায়ের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চারজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকি দু’টির মধ্যে একটির পূর্ণাঙ্গ ও একটির সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ।
চূড়ান্ত রায়ের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর গত বছরের ১১ এপ্রিল জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং ২১ নভেম্বর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি বহাল রেখে ৬ষ্ঠ আপিল মামলার রায় দেওয়া হয়েছে গত ০৬ জানুয়ারি।
অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বোচ্চ সাজা পুনর্বহালের আরজিতে রাষ্ট্রপক্ষ আর খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন জানিয়েছেন।
ঢাকা জার্নাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।