ইউনূসকে নিয়ে ‘থ্রেটও’ পেয়েছিলেন হাসিনা
মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরানোর পর বিদেশ থেকে হুমকিও পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি পদ্মা সেতুর প্রসঙ্গে বলেন, “পদ্মা সেতু বন্ধ করে দেবে, কোনো একটা বিশেষ ব্যক্তিত্বের একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকা, না থাকার ওপর। আমাকে সরাসরি থ্রেটও করা হয়েছে।”
ইউনূস পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন আটকাতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে সরকারের নানা ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে তা অস্বীকার করে আসছেন নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি।
বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অব্যাহতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়েও হেরে যান তিনি।
এরপর থেকে সরকারের সঙ্গে ইউনূসের বদানুবাদ চলছিল। এর মধ্যেই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প পদ্মা সেতু থেকে সরে যায় বিশ্ব ব্যাংক।
শিল্পকলা একাডেমিতে বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, “এই পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের ওপর দুর্নাম দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা… মূল টার্গেট ছিলাম, আমি, আমার পরিবার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং সচিব, কেউই বাদ যায়নি।”
তখন বিশ্ব ব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকেও বাদ দেওয়া হয়।
এরপর বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্পে অর্থায়নে ফিরে এলেও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানাপড়েন চলতে থাকে। এক পর্যায়ে সরকারই বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে।
শেখ হাসিনা ওই সময়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এমন ভাবে একটা ধোঁয়াশা অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল, যেন আমরা দুর্নীতি করে সব টাকা লোপাট করে দিয়েছি।”
“একটি পয়সা তারা দেয়নি, তার আগেই এই ধোঁয়া তোলো হল।”
“সেটা কেন, কার প্ররোচনায়, সেটা আমি বলতে চাই না। আপনারা ভালো করেই জানেন,” বলেন শেখ হাসিনা।
তখন বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
“আমেরিকার অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে সরাসরি বলেছেন, এটা না করলে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ হবে। এই কথা সরাসরি আমাকে শুনতে হয়েছে।”
“আমি মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম, পদ্মা সেতু আমরা নিজেরা করতে পারব।আমরা তা পেরেছি।”
পদ্মা সেতুর কথা বলার সময় ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ফিরিয়ে দিতে সরকারের উপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
“নানাভাবে, নানা চাপ। দুটা বছর যেন আমাদের ওপর আজাব সৃষ্টি করা হয়েছিল।”
“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করব। কেউ টাকা দিলে দেবো, না দিলে না দেবে। কিন্তু, আমরা যে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পারি- সেটা আমরা দেখিয়ে দিয়েছি।”
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফাঁস হওয়া ই-মেইলে মুহাম্মদ ইউনূসের মেইলও পাওয়া গেছে, যাতে গ্রামীণ ব্যাংকে পদ ফিরে পেতে হিলারির হস্তক্ষেপ কামনা করতে দেখা গেছে তাকে।
গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ফিরে পেতে ইউনূসের চেষ্টারবিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “ওই এমডির পদ তো আমার দেওয়ার কোনো সামর্থ্য ছিল না। কারণ, যার এই পদ, তিনি তো কোর্টে মামলা করেছিলেন সরকারে বিরুদ্ধে।
“ওই ব্যাংকের যে আইন, সে আইন ভঙ্গ করে ১০ বছর চালানোর পর কোর্ট তো তার বয়স কমাতে পারে না। মামলা করে যদি কেউ হেরে যায়- সে দায়দায়িত্ব তো আমাদের না, বাংলাদেশের জনগণের না।”
নিজের রাজনৈতিক লড়াইয়ে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনকে প্রেরণা নেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “সেখানে এত বড় বদনাম দেবে- সেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।”
নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে যে সাড়া পেয়েছেন, তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান সরকার প্রধান।
পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে পারি, তাহলে একটা সেতু করতে পারব না- এটা হয় না। কিছু রাজাকার-টাজাকার আর স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া আমরা ১৬ কোটি মানুষ আমাদের দেশটাকে সম্মানজনক জায়গায় নিতে পারি।”
“অনেকে মন্তব্য-টন্তব্য করেছিলেন। অনেকে অনেক কিছু লিখে টিখে আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন,” বলেন শেখ হাসিনা।
এই অনুষ্ঠানে দৈনিক দি ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামও ছিলেন। পদ্মা সেতু ও ইউনূস বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপে ভিন্নমত জানিয়ে সম্পাদকীয় অবস্থান প্রকাশ করেছিল ইংরেজি দৈনিকটি।
বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জোবায়দা এম লতিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন, ড. আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এবং সংসদ সদস্য বেগম নিলুফার জাফরউল্লাহ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য আনিসুল হক, বিজ্ঞানে অবদানের জন্য ড. হাসিনা খান, খেলাধুলায় ক্রিকেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ পুরস্কার পান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী।
পুরস্কারপ্রাপ্ত সকলেই একটি করে ক্রেস্ট, সনদপত্র, এক লাখ টাকার চেক এবং উত্তরীয় নেন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে।
শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম চারটি দেশের মধ্যে একটি হলেও অচিরেই প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে একটিতে উন্নীত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহে বিদ্যুত সংযোগের আশ্বাস দেওয়ার সঙ্গে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
শিক্ষা বিস্তারে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বানও জানান সরকার প্রধান।
“সমাজের বিত্তবানদের নিজ নিজ গ্রামের দিকে তাকাতে, নিজ এলাকার দিকে তাকাতে বলব, মানুষকে সহযোগিতা করতে বলব। বিত্তবানরা উচ্চ শিক্ষা প্রসারে এগিয়ে আসবেন, মেধাবীদের শিক্ষায় এগিয়ে আসবেন, যাতে তারা দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।”