Leadসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

বেড়েই চলেছে বাড়িভাড়া

03ভাড়া ১৬ হাজার টাকা, সার্ভিস চার্জ আরো চার হাজার। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলও ভাড়াটিয়ার। তিন মাসের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। বাসা ছাড়ার দুই মাস আগে জানাতে হবে। রাত ১১টার পরে বাসায় ঢোকা যাবে না। বাসায় চারজনের বেশি অবস্থান করা যাবে না। বেশি সংখ্যায় অতিথি গ্রহণযোগ্য নয়। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বিকাশের মাধ্যমে ভাড়ার টাকা বাসার মালিকের কাছে পাঠাতে হবে, বিকাশের খরচও দিতে হবে ভাড়াটিয়াকেই। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় তিন কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে সম্প্রতি এসব শর্ত শুনতে হয়েছে নাজিউর রহমানকে।

আসবাবপত্র উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা , তিনি জানান, বাড়িওয়ালা এত সব শর্ত দিলেও ভাড়ার বিনিময়ে কোনো চুক্তিতে নারাজ তিনি (বাড়িওয়ালা), এমনকি কোনো রসিদও দেবেন না। কত দিন পর পর বাসাভাড়া বাড়বে তাও জানাবেন না তিনি। বাড়িওয়ালাদের এমন স্বেচ্ছাচারিতায় নাকাল রাজধানীবাসী। অভিজাত এলাকা ছাড়িয়ে রাজধানীর নিম্নবিত্ত এলাকার অলিগলিতে কান পাতলেও শোনা যাবে ভাড়াটিয়াদের হাহাকার। চড়া ভাড়া, ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ানোসহ বাড়িওয়ালার স্বেচ্ছাচারিতার সাক্ষী হয়ে এ মহানগরীতে বসবাস করছে প্রায় দেড় কোটি ভাড়াটিয়া। শহরে বাসার অভাব আছে, কিন্তু ভাড়াটিয়ার অভাব নেই—এ সুযোগে বছরের পর বছর ধরে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে যাচ্ছেন বাড়িওয়ালারা।

সরকারও বাড়িভাড়া আইন কার্যকর না করে তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ সুযোগ করে দিচ্ছে। শুধু রাজধানী নয়, বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। নগরীর জামালখান সিঁড়িরগোড়া এলাকায় সাত মাস আগে তিন কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন। অগ্রিম দিতে হয়েছে এক লাখ টাকা, ভাড়া মাসে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু আগাম কোনো নোটিশ না দিয়েই চলতি মাসে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়েছেন তিন হাজার টাকা। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে একসঙ্গে এত টাকা বাড়িভাড়া বাড়ানোয় এখন চরম বিপাকে পড়েছেন আমজাদ হোসেন।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পান মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। পাঁচ মাস আগে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে দুই সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রী চট্টগ্রামের হেমসেন লেনের শরিফ কলোনি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। চারতলা ভবনের নিচতলায় দুই কক্ষের বাসাটির ভাড়া মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু চলতি মাসে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে আরো ৫০০ টাকা। রফিকুল ইসলালে  বলেন, ‘টানাটানির সংসার। ভাড়া বেশি হওয়ায় আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন এই বাসার ভাড়া পরিশোধ করতে আমার বেতনের অর্ধেক টাকাই তো শেষ হয়ে যাবে। সংসার চলে কী করে?’ চট্টগ্রামের ভাড়াটিয়ারা বলছে, নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় বছরের শুরুতেই অস্বাভাবিক হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়লেও অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষের তো আয় বাড়েনি।

কিন্তু বাসা ভাড়া ঠিকই বেড়েছে। বাসা ভাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল। কখনো কখনো বছরে দফায় দফায় বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়। এ নিয়ে বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে। ভাড়াটিয়ারা যেন বাড়িওয়ালাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।  জানা যায়, বাংলাদেশে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করা হয়েছিল ১৯৯১ সালে। কিন্তু সে আইনের বিধিমালা আজও হয়নি। আইনটি কার্যকর করতে কখনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে।

কিন্তু বাড়িভাড়া আইন রয়ে গেছে আগের মতোই। এমনকি সিটি করপোরেশন বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে হোল্ডিং কর আদায় করলেও তারা ভাড়া নিয়ে কোনো উদ্যোগ কখনো নেয়নি। ভাড়াটিয়া সমিতিগুলো কোথাও কোনো প্রতিকার না পেয়ে গত বছরের মাঝামাঝি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল। হাইকোর্ট সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণে সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও সরকার সেই কমিশন গঠন করেনি।  কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ঢাকায় গত ২৬ বছরে (১৯৯০-২০১৫) বাসা ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৩৮৮ শতাংশ।

সর্বশেষ ২০১২ সালে ৯.৭৩, ২০১৩ সালে ১০.৯১, ২০১৪ সালে ৯.৭৬ ও ২০১৫ সালে ৬.৩৩ শতাংশ হারে ভাড়া বেড়েছে। ক্যাবের হিসাবে, এখন ঢাকায় দুই কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিতে খরচ হয় গড়ে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা, যা ২০১০ সালেও ১১ হাজার ৩০০ টাকা ছিল।  সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাঁদের মতে, প্রথমে আইন সংশোধন করতে হবে। এরপর ত্রিপক্ষীয় (ভাড়াটিয়া, বাড়িওয়ালা ও সরকার) কমিটি করে ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। এরপর আইন কার্যকর করতে চুক্তিপত্র, রসিদ নিশ্চিত করতে হবে এবং তদারকি বাড়াতে হবে। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার যদি ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি করে তাহলে সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে ভাড়া নির্ধারণ সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধন ও ভাড়া নির্ধারণের উদ্যোগ সিটি করপোরেশনকেই নিতে হবে।’ ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে’ দুই বছরের আগে ভাড়া বাড়ানো যাবে না, এক মাসের ভাড়ার বেশি অগ্রিম নেওয়া যাবে না, কোনো জামানত বা সেলামি নেওয়া যাবে না, প্রতি মাসে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করলে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বাড়িওয়ালা—এরকম অনেক কিছুই আছে। কিন্তু ভাড়াটিয়ারা এসব সুবিধা কখনোই পাননি।  মালিক ভালো হলে ভাড়াটিয়ারা শান্তিতে থাকতে পারে, তা না হলে বছর বছর বাসা পাল্টাতে হয়। রাজধানীতে বাসা পাল্টানোর হার এত বেশি যে এতে সহযোগিতা করতে আলাদা ব্যবসাও গড়ে উঠেছে। অথচ ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য সেই পাকিস্তান আমলেও আইন ছিল, এখনো আছে। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশ প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে।

১৯৯১ সালে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন হয়। কিন্তু এ আইনের কোনো সুফল কখনো আবাসিক ভাড়াটিয়ারা পায়নি। কারণ আইনটি কার্যকর করতে কোনো সংস্থা কাজ করেনি। ওই আইনে বিভিন্ন এলাকার জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার তা নিয়োগ দেয়নি। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৬৪ লাখ। দুই সিটি করপোরেশন মিলে হোল্ডিং সংখ্যা দুই লাখ ৭৯ হাজার। প্রতি বাড়ির মালিকের পরিবারে গড়ে পাঁচজন করে সদস্য ধরলে ঢাকায় মালিকদের পরিবারের জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ লাখ। এ হিসাবে ঢাকায় ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ভাড়া বাসায় বসবাস করে। চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণহীন বাড়িভাড়া প্রতিরোধ কমিটির হিসাবে এ মহানগরীর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এর মধ্যে ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ লোক ভাড়া বাসায় থাকে। মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লোক থাকে নিজ বাড়িতে। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া বলেন, প্রতিকারের সুযোগ আছে কেবল আদালতে গেলে। সেখানে একজন সহকারী জজকে রেন্ট কন্ট্রোলার (ভাড়া নিয়ন্ত্রক) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া আছে। কিন্তু ভোগান্তির ভয়ে সাধারণ মানুষ সেখানে যায় না। সাধারণ ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ সেখানে নেই বললেই চলে। গত বছর ১ জুলাই একটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হলেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি সরকার। ভাড়াটিয়া কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ তৌকির আহমেদ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি।

সরকার গা করেনি। অবশেষে হাইকোর্টের রায়ও অগ্রাহ্য করল সরকার। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন করবে কোন মন্ত্রণালয়, তার উল্লেখ নেই এ আইনে। এ কারণে সবাই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।  ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, করপোরেশনের ভেতরে এলাকাভেদে একটি ন্যূনতম বাড়িভাড়ার হিসাব ধরে কর আদায় (হোল্ডিং ট্যাক্স) করা হয়। ন্যূনতম সেই হিসাবের চেয়ে কম অঙ্কের বাড়িভাড়া ধার্য করে কর আদায় করা যাবে না। তবে করপোরেশনের ধার্য করা ভাড়ার অঙ্ক কেবল করের সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনোভাবেই তা প্রকৃত বাড়িভাড়া হিসেবে ধরা যাবে না। বাড়িভাড়া নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ সিটি করপোরেশনের আওতার মধ্যে পড়ে না।  চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণহীন বাড়িভাড়া প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক শরীফ চৌহান গতকাল শুক্রবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ে আইন থাকলেও তা মালিকরা মানেন না। কিছুদিন যেতে না যেতে তাঁরা ইচ্ছামতো বাসা ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আমরা আন্দোলন করলেও এখানকার প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত করছে না। ভাড়া নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও ভাড়াটিয়াদের স্বার্থরক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’ ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বাড়ির মালিকদের কাছে ভাড়াটিয়ারা জিম্মি হয়ে পড়েছে। ভাড়াটিয়াদের ব্যাপারে সরকার বরাবরই দায়সারা আচরণ করছে।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আহমেদুল হক বলেন, ‘বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে এখনো করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো আইন হয়নি। তবে আইন প্রণয়নের কাজ চলছে।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.