Leadসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

স্কুলে স্কুলে ফি হঠাৎ দ্বিগুণ

10ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি স্কুল মাত্র ৩৫টি। সেগুলোতে চলতি বছর সব শ্রেণি মিলিয়ে মাত্র ১০ হাজার ২০০ নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অন্যরা ছুটছে রাজধানীর ৩৪১টি বেসরকারি স্কুলে। এ ছাড়া কয়েক হাজার কিন্ডারগার্টেনেও অভিভাবকরা ভর্তি করাচ্ছেন সন্তানদের। কিন্তু কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ করে বড় স্কুলগুলো টিউশন ফি ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। মাসে ৮০০ টাকা ফি জেনে সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করানোর পর এখন অভিভাবকদের দিতে হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা। ভর্তি ফিও বাড়ানো হয়েছে অস্বাভাবিক হারে। শিক্ষার এই বাড়তি খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। কয়েকটি বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, নতুন পে স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার্থীদের ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত হলেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বেশির ভাগ শিক্ষকের বেতন স্কুল কর্তৃপক্ষকেই দিতে হয়। কোনো স্কুলেই ১০ শতাংশের বেশি শিক্ষক এমপিওভুক্ত নয়। নতুন পে স্কেলের কারণে এই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় অন্য শিক্ষকদেরও বেতন বাড়াতে হবে। তাই শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন বাড়াতে হচ্ছে বলে যুক্তি স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু অভিভাবকরা একে খোঁড়া যুক্তি হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, স্কুলের ফি বাড়ছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ।

এর ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত টাকা আদায় হবে, শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে এর এক-চতুর্থাংশও খরচ হবে না। মূলত নানা খাতে খরচ দেখিয়ে এই বাড়তি টাকায় পকেট ভারী করবেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। জানা যায়, ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চার ক্যাম্পাস মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। আর শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭৫০ জন। এর মধ্যে ৫২ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। বাকি প্রায় ৭০০ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বাড়াতে ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর টিউশন ফি বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে স্কুল কর্তৃপক্ষের যে আয় হবে, শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে তার চার ভাগের এক ভাগও ব্যয় হবে না বলে জানা গেছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯ হাজার ৩২২ জন। আর ৪৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর ৩৪ জন এমপিওভুক্ত। বাকি ৩৯৮ জনের বেতন বাড়াতে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর ফি দ্বিগুণ করা হয়েছে। অথচ শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে খুব সামান্যই ব্যয় হবে।  জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন   বলেন, ‘সরকার নতুন পে স্কেল দিয়ে বলেনি যে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকেই তা কার্যকর করতে হবে। আর স্কুলগুলো যে পরিমাণ ফি বাড়ায়, এর চারভাগের এক ভাগও শিক্ষকদের পেছনে ব্যয় করে না। আমাদের আওতায় যতটুকু সম্ভব ততটুকু ব্যবস্থা আমরা নেব। নীতিমালার বাইরে কারো যাওয়ার সুযোগ নেই। অভিভাবকরা অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলোর খরচেও বিস্তর ফারাক লক্ষ করা গেছে। সরকারিতে প্রাথমিক স্তরে ফি নেওয়া হয় না। আর ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে নেওয়া হয় মাসে ১০ টাকা। নবম ও দশম শ্রেণিতে ফি নেওয়া হয় ১৫ টাকা। তবে টিফিন ভাতা নেওয়া হয় মাসে ৭৫ টাকা। আর ভর্তি ফি মাত্র এক হাজার ২৫০ টাকা। নতুন পে স্কেল হলেও সরকারি স্কুলের টিউশন ফি কিন্তু বাড়েনি।

অথচ বেসরকারি স্কুলে এক হাজার টাকার ফি বাড়িয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকাও করা হয়েছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন বড় স্কুলের অভিভাবকদের কাছে জানা যায়, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফি বাড়ানোর খবর পাওয়া গেছে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক হাজার ৬০০ টাকার ফি দুই হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গত আগস্ট মাসে ফি বাড়িয়েছে। চলতি বছরও তারা প্রতি ক্লাসে ১০০ টাকা ফি ও এক হাজার টাকা ভর্তি ফি বাড়িয়েছে। তারাও বড় ধরনের ফি বৃদ্ধির চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে। যেহেতু অভিভাবকদের আন্দোলন চলছে, তাই অন্যান্য স্কুলে পরিস্থিতি বুঝে ফি বাড়ানোর পাঁয়তারা রয়েছে। রেবেকা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে প্রথম শ্রেণির টিউশন ফি এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার ২৫০ টাকা করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির এক হাজার ৫০০ টাকার ফি দুই হাজার ৫৫০ টাকা করা হয়েছে।’ এই স্কুলে হঠাৎ করে এভাবে ফি বাড়ানোয় অভিভাবকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেন। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস এ বিষয়ে তদন্ত করে এর সত্যতাও পেয়েছে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনো ফি কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবুল হোসেন ফি বাড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘না বাড়িয়ে তো উপায় নেই। আমাদের মাত্র ৩৪ জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত। বাকি ৩৯৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন দিতে হয় স্কুল ফান্ড থেকে। সরকার নতুন পে স্কেল ঘোষণা করায় ওই ৩৪ জনের মতোই অন্যদের বেতন-ভাতা বেশি দিতে হবে। এ জন্যই শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি বাড়ানো হয়েছে।’ রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা বেইলি রোডের প্রধান ক্যাম্পাসের সামনে গত বুধবার ও গতকাল বৃহস্পতিবার ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। অভিভাবকরা জানান, প্রথম শ্রেণির ফি ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই কার্যকরও হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ৮০০ টাকার ফি বাড়িয়ে এক হাজার ৬০০ টাকা করা হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ৯০০ টাকার ফি দুই হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। লস্কর হারুনুর রশীদের দুই মেয়ে অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে পড়েন এই স্কুলে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার পে স্কেল দিয়েছে সরকারি চাকুরেদের জন্য। কিন্তু সেই ভার কেন আমাদের ওপর বর্তাবে? আমি নিজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।

আমার এই বছর বেতন বাড়বে না বলে মালিক বলে দিয়েছেন। তাহলে আমরা এই বাড়তি টাকা কিভাবে জোগাব? আর শুধু স্কুলের ফি তো নয়, বাচ্চাদের একাধিক প্রাইভেটও পড়াতে হয়। সেখানেও তো খরচ বেড়ে যাবে।’ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের মাত্র ৭ শতাংশ শিক্ষক এমপিওভুক্ত। তাঁদের যদি বেতন বাড়ে, অন্যদেরও বাড়াতে হবে। সরকার যেহেতু নতুন স্কেল দিয়েছে বেতন না বাড়ালে চলাই যাবে না। আমরা প্রথম শ্রেণির ফি বাড়িয়েছি। দ্বিতীয় থেকে দশম শ্রেণির ফি বাড়ানোর ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। পরিচালনা কমিটি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’ উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত টিউশন ফি ছিল ৮০০ টাকা। তা এ বছর বাড়িয়ে করা হয়েছে এক হাজার ২০০ টাকা। আর কেজি শ্রেণির ফি এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। এ ছাড়া আইসিটি, ল্যাব, লাইব্রেরিসহ সব ক্ষেত্রেই ফি বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি নীতিমালা-২০১৫-তে বলা হয়েছে, রাজধানীর এমপিওভুক্ত স্কুলে ভর্তিতে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা, আংশিক এমপিওভুক্ত ও এমপিওবহির্ভুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ফি নেওয়া যাবে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এই নীতিমালা মানছে না। নানা খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। তবে মাসিক ফির ব্যাপারে নীতিমালায় কিছু বলা নেই। সেই সুযোগে স্কুল পরিচালনা কমিটি ইচ্ছেমতো ফি আদায় করছে। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘ভর্তি নীতিমালায় ফির বিষয়টিও নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি। যেহেতু প্রতিবছরই ভর্তি নীতিমালা করা হয়, তাই ফি বাড়ানো লাগলে মন্ত্রণালয়ই বাড়িয়ে দিতে পারে। তাহলে স্কুলগুলো দ্বিগুণ হারে ফি বাড়ানোর সুযোগ পাবে না। আর মাউশি শুধু বলে, অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেব। কিন্তু অভিভাবকরা রাস্তায় নামছেন, পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে, তাদের মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তা রয়েছেন, এর পরও তাদের অভিযোগ দিতে হবে কেন? তারা কী অন্ধ? তাদেরই স্ব-উদ্যোগে স্কুলগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.