এমপি দবিরুলের ‘দখলের’ প্রমাণ পাওয়ার দাবি
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখলের অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রমাণ করার কথা বলেছে নয় সংগঠনের একটি মোর্চা।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেল’ এর ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে এই ‘তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন’ প্রকাশ করা হয়।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকটি হিন্দু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় এমপি দবিরুলের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ অস্বীকার করে উস্কানিমূলক খবর প্রকাশ করা হয়েছে দাবি করেন তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, এর পেছনে সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের হাত আছে।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করে অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী বলেন, বালিয়াডাঙ্গীতে জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত ১৯ জুন সাংসদের ছেলের নেতৃত্বে অন্তত ৩০ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা করে।
“হামলার পর অকুলচন্দ্র পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন ভাকারাম সিংসহ ৮/১০ জন, সন্ত্রাসীরা কয়েকজন নারীকেও মারধর করে।”
জমি দখল, সহিংস হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা একাধিকবার ঘটলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এবং স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন তথ্যানুসন্ধান দলের এই সদস্য।
জমিদখল নিয়ে বিরোধের কারণ ব্যাখ্যা করে সুব্রত বলেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ও তার পরিবারের সদস্যরা বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নে ‘রনবাগ ইসলাম টি এস্টেট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তুলেছেন। তিন দিক ভারত সীমানাবেষ্টিত দক্ষিণ পাড়িয়া মৌজার পশ্চিমাংশে এই চা বাগানের বেশিরভাগ।
১০৬ একর আয়তনের ওই অংশের মাঝখানে ১০টি হিন্দু পরিবারের প্রায় ৩৫ একর চা বাগান ও আবাদি জমি। এর মধ্যে অকুল চন্দ্র সিংয়ের এক বিঘার ওপর দিয়ে অন্যদের জমিতে যেতে হয়।
“করিডোরের মতো এই এক বিঘা দখল হলে সংখ্যালঘু ১০ পরিবারের লোকজন তাদের জমিতে যাওয়ার পথ পাবে না। কারণ তাদের জমি ও বাগানের চারপাশ ঘিরে আছে এমপির চা-বাগান।”
সুব্রত বলছেন, দবিরুলের ছেলে মাজহারুল ইসলাম সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে তাদের জমি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ পেয়েছেন তারা।
“সাংসদের লোকজনের বাধায় ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নেতা প্রয়াত হেলকেতু সিংয়ের ছেলে বধুরাম সিং তার ৯৩ নম্বর দাগের ২৭ শতাংশ জমিতে চাষ করতে পারেন না। একই মৌজায় ২ নম্বর দাগের অধিকাংশ খাস জমি দখল করে রেখেছে সাংসদের পরিবার। ৪ নম্বর দাগে নাগর নদী তীরের শ্মশানে যাওয়ার রাস্তার খাস জমি দখল করে চা বাগান করার চেষ্টাও করেছে সাংসদের লোকজন।”
গত ২৪ ও ২৫ নভেম্বর বালিয়াডাঙ্গীতে গিয়ে সমন্বয় সেল এসব তথ্য পায় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সমন্বয় সেলের সংগঠনগুলো হল- আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, এএলআরডি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, নিজেরা করি ও এইচডিআরসি। তাদের সঙ্গে বালিয়াডাঙ্গীতে তথ্যানুসন্ধানে কাজ করে দিনাজপুরের সিডিএ নামের একটি সংগঠন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালসহ তথ্যানুসন্ধান দলে ছিলেন অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি তবারক হোসেইন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন ও সিডিএ’র নির্বাহী পরিচালক শাহ ই মবিন জিন্নাহ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে দবিরুলসহ কয়েকজন এমপি ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, “যারা ক্ষমতাবান তারা বিভিন্নভাবে দুর্বলের জমি দখল আর সম্পত্তি দখল করছে; হামলা চালাচ্ছে সম্পদ ও পরিবারের ওপর। বেশিরভাগ জায়গায় এমপি ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আসছে। তারা যাতে সতর্ক হন, এ আহ্বান আমরা জানাচ্ছি।”
তবে দবিরুল ছাড়া কারও নাম স্পষ্ট করেননি সুলতানা কামাল।
সাংবাদিকরা অন্যদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাংসদ দবির জড়িত থাকার সুষ্পষ্ট প্রমাণ তো আপনারা পেলেন। ফরিদপুরে মন্ত্রীর জড়িত থাকার কথা এসেছে।”
তার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, “ঠাকুরগাঁও-ফরিদপুর ছাড়া গত কয়েকদিন আগে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে একজন মন্ত্রীর দ্বারা জমি দখল ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।”
এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এবং পিরোজপুরে সাংসদ এ কে এম এ আউয়ালের নামও বলেন কাজল দেবনাথ।
বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা জিতেন চন্দ্র সিং সংবাদ সম্মেলনে তার ছোট ভাই ভাকারাম সিংয়ের ওপর এমপির ছেলের নেতৃত্বে হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “তারা জমি দখল করতে এসেছিল। এক পর্যায়ে তারা ভাকারামকে পায়ে-পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপায়।”
হামলার পর থেকে তার ছেলে অভিলাল সিং দিল্লিতে থাকছেন জানিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিতেন চন্দ্র বলেন, “চাচার ওপর হামলার পর ছেলে বলছিল, বাবা আর দেশে থাকব না, চলো ভারত চলে যাই। পরে সেই নিজেই চলে গেল।”
এ সময় সুলতানা কামাল বলেন, “সবলের অত্যাচারের কারণে দুর্বল ভাবছেন তারা দেশে থাকবেন না, এটা তো আমরা মেনে নিতে পারি না। অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হামলা যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।”