সব সংবাদ

শমসের মবিনের পদত্যাগে বিব্রত বিএনপি

14হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত বিএনপি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছে, তখন দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগে বিব্রত বিএনপি। বিশেষ করে দুই দফায় সরকার বিরোধী আন্দোলনে ‘কার্যত ব্যর্থ’ দলটি যখন কঠিন সময় পার করছে, তখন একজন শীর্ষ নেতার এমন আকস্মিক পদত্যাগে নেতা-কর্মীদের মাঝে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও বিএনপির নেতারা বিষয়টি ঠিক ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলেই গুরুত্ব দিতে চান।

তারা বলছেন, শারীরিক কারণে ব্যক্তিগতভাবে কেউ অবসর নিতেই পারেন। এতে দলের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।

যেমনটি বলছিলেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘তিনি (শমসের মবিন চৌধুরী) কিছুদিন আগেই কারাগার থেকে বেরিয়েছেন। শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালোও যাচ্ছিল না। তিনি তার এলাকায় পর্যন্ত যাননি। এমনকি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎও করছেন না। সেজন্য তিনি রাজনীতিতে থাকছেন না-এমন একটি অনুমান হচ্ছিল। এ ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের মাঝে মানসিক প্রস্তুতি ছিল।’

শমসের মবিনের পদত্যাগ দলে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না-জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেখেন, তিনি (শমসের মবিন চৌধুরী) বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দলের অ্যাকটিভ রাজনীতিবিদ অর্থাৎ মাঠের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না। আর কেউ ব্যক্তিগতভাবে পদত্যাগ করতেই পারেন। এতে দলে কোনো প্রভাব পড়বে না।’

এদিকে বিএনপির গুলশান কার্যালয় ও লন্ডন সূত্রে জানা গেছে, শমসের মবিনের পদত্যাগের খবরটি বুধবার সন্ধ্যার পরই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অবহিত করা হয়েছে।

বিএনপি নেত্রীর ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত দলের একজন নেতা   বলেন, দলের এই সময়ে তার পদত্যাগ করা উচিত হয়নি। তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারতেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার দরকার ছিল না। এমনিতেই মামলা-গ্রেফতার দিয়ে সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতাদের চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় পদত্যাগ করে তিনি বিএনপির হাইকমান্ডকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।

শমসের মবিন এমন সময়ে দল থেকে পদত্যাগ করলেন যখন বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা জেলে রয়েছেন। অসংখ্য মামলা রয়েছে অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে। কারাগারে আসা যাওয়ার মধ্যে রয়েছে দলটির নেতা-কর্মীরা। একাধিক মামলা চলছে দলের দুই কান্ডারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং প্রায় আট বছর লন্ডনে অবস্থানরত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও। সর্বশেষ এক মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে ১৩ বছরের কারাদ- দিয়েছে আদালত।

তবে শমসের মবিন চৌধুরীর আকস্মিক এই পদত্যাগ বিএনপির আন্দোলন বা নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ক্ষেত্রে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয় বলে মনে করেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু , তিনি বলেন, সরকারের নির্যাতনে যদি বিএনপির সব নেতাও রাজনীতি থেকে অবসর নেয় তাতেও দলের কিছু হবে না। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ঠিক থাকলে সব ঠিক। শেখ মুজিবুরের আমলেও অনেক নেতা অবসর নিয়ে রাজনীতি থেকে সরে গেছেন। তাতে আওয়ামী লীগের কিছু হয়নি। মূল কথা নেতা-কর্মীদের মাঝে আদর্শ ঠিক থাকলেই হল। তাহলে লক্ষ্যে পৌঁছানো কোনো ব্যাপার নয়।

শমসের মনিব চৌধুুরীর পদত্যাগের বিষয়টিকে ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে ব্যক্তিগত’ সিদ্ধান্ত বলে দেখতে চান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান।  তিনি বলেন, ‘শরীর ঠিক না থাকলে তো কিছুই ঠিক নেই। তাই কেউ যদি মনে করে শারীরিক অসুস্থতার কারণে এই মুহূর্তে তার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ঠিক নয়, তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করতেই পারেন। বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে দেখাই উচিত।’

দীর্ঘ সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার পর শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বুধবার বিএনপির রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করেন শমসের মবিন চৌধুরী, যিনি দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিএনপির যে ক’জন নেতা দলের আন্তর্জাতিক বিষয়টি দেখভাল করতেন শমসের মবিন তাদের মধ্যে অন্যতম।

পদত্যাগের কথা জানিয়ে শমসের মবিন চৌধুরী  জানান, শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছি। সেজন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। বুধবার সন্ধ্যায় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে এই পত্র জমা দেন বলে জানান তিনি।

শমসের মবিন বিএনপি চেয়ারপারসনের খুবই ঘনিষ্ট বলে দলের মধ্যে পরিচিত ছিলেন। তিনি এমন সময়ে দল থেকে পদত্যাগ করলেন যখন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দুই বছর চাকরির মেয়াদ শেষে করে ২০০৮ সালে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপিতে যোগ দেন শমসের মবিন চৌধুরী। সে সময় চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পান তিনি।

২০০৯ সালে বিএনপির কাউন্সিল হলে শমসের মবিনকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত শমসের মবিন চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে।

শমসের মবিন চৌধুরীর পৈতৃক বাড়ি সিলেট জেলায়। তার বাবার নাম আবদুল মবিন চৌধুরী এবং মায়ের নাম তাহমেদুন নাহার। স্ত্রী শাহেদা ইয়াসমিন। তাদের দুই ছেলে রয়েছে।

১৯৭১ সালে শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধকালে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের যুদ্ধে তিনি আহত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে বন্দি করে। নভেম্বর মাসে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট আনা হয় এবং বলা হয় কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে তিনি মুক্ত হয়ে যান।

শমসের মবিন চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত থাকাকালে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। পর্যায়ক্রমে পররাষ্ট্র সচিব পদে উন্নীত হন এবং পরে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন শমসের মবিন।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.