তসলিমা নাসরিনের ‘অবকাশ’
তসলিমা নাসরিন : অবকাশ। বাড়ির নাম। কালো গেটের পাশে মাধবীলতার তলায় শ্বেত পাথরে খোদাই করা বাড়ির নাম। নামটা বাবা রেখেছিলো। বাড়িটা বাইরে থেকে খুব সুন্দর ছিল একসময়। হোয়াইট ওয়াশ করা হতো বছর বছর। তখনকার কোনও ছবি নেই আমার কাছে। আদৌ কি তোলা হতো কোনও ছবি? মনে হয় না। ময়মনসিংহ শহরের অবকাশে আমি আমার ৭ বছর বয়স থেকে ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত বাস করেছি। এই বাড়িটা বাবা কিনেছিলো যখন আমরা শহরের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারে থাকি, নামেই কোয়ার্টার, আসলে বড় একটা আবাসিক এলাকা। ওখানে নানির বাড়ি। নানির বাড়িতে আমার দাদাদের আর আমার জন্ম। ওখানেই কাটিয়েছি শিশুকাল। রেললাইনের কাছেই ছিল বাড়ি। ছুটে ছুটে চলন্ত রেলগাড়ি দেখতে যেতাম।
অবকাশের ঠিকানা, ১৮ টি এন রায় রোড। সম্ভবত তেজেন্দ্র নারায়ণ রায় রোড। কে একজন টি এন এর মানে দাঁড় করিয়েছিল তসলিমা নাসরিন। চিঠিও লিখতো ১৮, তসলিমা নাসরিন রায় রোড বলে। চিঠি আসতোও। বাড়ির ভেতরে বাইরে কিছু ছবি যা হাতের কাছে পেয়েছি, দিচ্ছি। কত শত ছবি হারিয়ে গেছে। কত শত ছবি নষ্ট হয়ে গেছে। ভাবলে খারাপ লাগে। ছবি কত কথা মনে করিয়ে দেয়, যা এমনিতে হয়তো ভুলে যাই।
অবকাশের ভেতরটা ঠান্ডা ঠান্ডা ছিল। উঁচু সিলিং, কড়িকাঠ। বড় বড় দরজা। বড় বড় জানালা। ছাদে ওঠার স্পাইরাল সিঁড়ি। উঠোনে মাঠে প্রচুর ফল ফুলের গাছ। কত গাছ যে ছিল আমাদের অবকাশে। সেগুন থেকে শুরু করে কাঁঠাল গাছ, কামিনী থেকে শুরু করে দোলনচাঁপা।
অবকাশে আমার শৈশব কৈশোর যৌবন কেটেছে। অবকাশ থেকে আমি শহরের বিদ্যাময়ী ইস্কুলে পড়তে যেতাম, রেসিডেন্সিয়াল মডেল ইস্কুলে যেতাম। যেতাম মুমিনুন্নিসা মহিলা কলেজে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। কলেজ পাশ করে ময়মনসিংহ শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরি করেছি। বদলির চাকরি। ময়মনসিংহ থেকে যখন ঢাকায় বদলি হয়ে গিয়েছি, অবকাশে খুব কমই আসা হতো। মাঝে মাঝে বাবা মাকে দেখতে আসতাম। অবকাশটাকেও দেখতে আসতাম। এখন বাবা মা নেই। আমার বড়দা অবকাশে থাকে। সে নাকি পুরোই পাল্টে ফেলেছে বাড়ি। বিশাল দরজা জানালা নাকি ভেঙে টেঙে আধুনিক বাড়ির মতো কিছু করেছে। আমার যেন ও বাড়িটি নিজ চোখে আর দেখতে না হয়। যারা পুরোনো স্থাপত্যের মর্যাদা দিতে জানে না, তাদের জন্য দুঃখ করা ছাড়া আর কী করবো!
ঢাকা জার্নাল: আগস্ট ২, ২০১৫