এক মানুষের তিন ঠিকানা
ছিটমহলের বাসিন্দা রেজাউল মণ্ডলের সাকিন (ঠিকানা) তিনটি। এক: তিনি ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার বয়রা গ্রামের বাসিন্দা। দুই: বাংলাদেশের যশোর জেলার ৯ নম্বর সরূপদাহ ইউনিয়নের গদাধরপুর গ্রামে তার বসবাস।
আর যেহেতু তিনি সীমান্তবর্তী ছিটমহলের বাসিন্দা তাই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর খাতায়ও রেজাউলের আরেকটি সাকিন আছে। সেটি হচ্ছে তিনি আসলে ‘নো ম্যান্সল্যান্ডের’ বাসিন্দা। যে ঠিকানায় কোনো জেলা-থানা-গ্রাম-পাড়া নেই, রেজাউলকে চিহ্নিত করা হয় কাঁটাতারের বেড়ার হিসাব ধরে। সেই হিসাবে তিনি ‘নো ম্যানন্সল্যান্ডের ৩৯/১১ নম্বর পিলারের’ বাসিন্দা।
দেশ বিভাগের রাজনীতি শুধু রেজাউলের রান্নাঘরকে বাংলাদেশে, আর শোবার ঘরকে ভারতে ফেলেনি, বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল এবং ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অনেক বাসিন্দাকেই ‘ভাগের মানুষ’ করে রেখেছে। তারা সকালে জাল দিয়ে বাংলাদেশের খালে-বিলে মাছ ধরেন, আর সেই মাছ রান্নার তেল-লবণ-নুন আনতে সন্ধ্যায় যেতে হয় ভারতের বাজারে।
রেজাউল মণ্ডল (৬৫) জন্ম ও নাগরিকত্ব সূত্রে ভারতের বাসিন্দা। কোনো এককালে ছিল তার পরিবারের জৌলুস। কিন্তু সব জৌলুস উবে যায় সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেই। নিজের বসতবাড়ি ও জমি-জায়গা ভাগ হয়ে যায় দুদেশের মধ্যে।
রেজাউল এটিএন টাইমসকে জানান, এ ভাগাভাগির মধ্যে পড়ে তার ১৬ বিঘা চাষের জমি। এর মধ্যে ভারতে ৮ বিঘা আর বাংলাদেশে ৮বিঘা।
জমির খাজনা ও কর মেটাতে হয় দুদেশের সরকারকে। আর চাষাবাদ, ফসল ঘরে তোলা সবকছিুই করতে হয় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ এর অনুমতি নিয়ে। রেজাউলের বসতবাড়ির পেছনের জলাশয়টি পড়েছে বাংলাদেশের মধ্যে। সেখানকার চাষ করা মাছ বিক্রি করেন ভারতে গিয়ে।
এতকিছুর পরেও তো রেজাউল মেনে নিয়েছিলেন তার ‘ভাগাভিাগির’ জীবন। মনের দুঃখের আগুন, জীবনের টানে ছাইচাপা দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধে, যখন তিনি একটি পাকা বাড়ি করতে চান। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো দেশ থেকেই বাড়ি পাকা করার অনুমতি আদায় করতে পারেননি রেজাউল।
সীমান্ত-লাগোয়া রেজাউলের ছিটমহল-গ্রাম। সেখানে প্রায় ৬০টি পরিবারের বসবাস। সীমান্তের পিলার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এসব বসতি। তার মধ্যে শুধু রেজাউলের ভাগ্যে জুটেছে এ অভিনব ব্যবস্থা।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশের স্থলসীমা নিয়ে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আওতায় দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় করার কথা বলা হয়। এছাড়াও দুই দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ জমি ও সাড়ে ৬ কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা সমস্যার সমাধানের কথাও বলা হয় প্রটোকলে। সে কাজ খুব বেশিদূর না এগানোয় নিজেদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি।
ফলে রেজাউল মণ্ডলের জীবনে খুব পরিবর্তন আসেনি। তার পারিবারিক জীবনেও আছে এই ‘ভাগের’ হিসাব।
তিনি জানান, তার চার ছেলে ও দুই মেয়ে। এর মধ্যে এক মেয়ে মর্জিনার বিয়ে দিয়েছেন যশোরের মনিরামপুর থানার প্রতাপকাঠি গ্রামে। এক ছেলে হাফিজুর চাকরি করেন কলকাতা পুলিশ বিভাগে। অন্য ছেলেরা পড়ে আছেন চাষাবাদ নিয়ে।
রেজাউল মণ্ডলের এখন একটাই আশা, “যদি একটা পাকাবাড়ি করার অনুমতি পেতাম তাহলে আর কোনো সমস্যাই থাকত না।”
লিখেছেন- মুকুল বসু, কলকাতা
সৌজন্যে এটিএন টাইমস।