ভাষা আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরে রাজশাহীতে
এস এম আববাস: ভাষা আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরেছিল রাজশাহীতে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে একমাত্র রাজশাহীতেই আন্দোলনের তীব্রতা ছিল ভিন্ন রকম। আর এই ভিন্নতার কারণেই ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম রক্ত ঝরে রাজশাহীতে।
এমনকি ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে প্রথম শহীদ মিনারও তৈরী হয় রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের সামনে। যদিও সেই শহীদ মিনারটি পুলিশ ২১ ফেব্রুয়ারী সকাল ১০ টার দিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল। শহীদ মিনার ভাঙ্গার ঘটনায় কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন,“ইঁটের মিনার ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক/একটি মিনার গড়েছি আমরা চার কোটি কারিগর/বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণ লেখায়।”
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রয়ারী ভাষার দাবীতে রাজশাহীতে প্রথম মিছিল শুরু করে স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা। মিছিলকারীদের উপর নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের গুণ্ডারা লাঠি ও লোহার রড দিয়ে হামলা চালিয়ে ১৮ জন ছাত্র-ছাত্রীকে আহত করে। গুরুতর জখম ছাত্র গোলাম রহমানের রক্তে প্রথম রঞ্জিত হয় রাজশাহী শহরের ফায়ার সার্ভিস মোড়ের রাস্তা।
১৯৪৭ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীর ভুমিকা ছিল ব্যাতিক্রমি। গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের উদ্যোক্তা শহিদুল্লাহ কায়সার, শামসুল হক, আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহা, জননেতা আতাউর রহমান,আজিজ আহমদ, আলী আহাদ, তাসাদ্দুক হোসেন, তাজউদ্দিন আহমেদ, শামসুদ্দীন আহমদ, মিসেস হাজরা মাহমুদের চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাজশাহীতে। আতাউর রহমান রাজশাহীতে ফিরেই ওই সংগঠনের শাখা দাঁড় করান। মোঃ আনসার আলীর (পরবর্তীতে হাইকোর্টের বিচারপতি) নেতৃত্বে ২ সেপ্টেম্বরে রাজশাহীতে তামাদ্দুন মজলিস’র (ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন পাকিস্তান) শাখা খোলা হয়।
১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারী রাজশাহীতে জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। মোহাম্মদ সুলতানের নেতৃত্বে ৩১ জানুয়ারী উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে রাজশাহীতে প্রতিবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করে। পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরুর পর ২৫ ফেব্রুয়ারী স্কুল কলেজের ছাত্ররা ভাষার দাবীতে ব্যাপকভাবে মিছিল ও ধর্মঘট পালন করে। ওই দিনই হাই মাদ্রাসার সামনে ফায়ার ব্রিগেট মোড়ে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা লাঠি ও লোহার রড দিয়ে হামলা চালায়। গুরুতর আহত হন ছাত্র নেতা গোলাম রহমান, ছাত্র ফেডারেশন নেতা আব্দুল লতিফ, ব্রতিষ ঘোষ, ফজলুর রহমানসহ ১৮ জন। গুরুতর আঘাতে গোলাম রহমানের মাথা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এটিই ভাষার দাবীতে প্রথম রক্ত ঝরা।
পরে পুলিশ মিছিলকারীসহ প্রায় ৯’শ জনকে আটক করে। আটকদের মধ্যে ৬৯ জনকে জেলে পাঠিয়ে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই দিন বেলা ১১টায় শহরের কেন্দ্রস্থল ভূবনমোহন পার্কে ছাত্রদের সভা হয়। পরপর দু’দিন ১১ ও ১২ মার্চ রাজশাহীতে হরতাল পালিত হয়। প্রথম দিন ভুবনমোহন পার্কে মিটিং হয় এবং “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগানের ব্যাজ বিক্রি করা হয়। দ্বিতীয় দিন ১২ মার্চ আবারো সফলভাবে হরতাল পালিত হয়। বছরের শেষ দিকে (১৯৪৮ সাল) হাবিবুর রহমান শেলী (পরবর্তীতে বিচারপতি) মুহাম্মদ সুলতানসহ অনেকে পড়াশুনার জন্য ঢাকায় চলে যান।
নতুনভাবে নেতৃত্বে আসেন এস এ বারী, গোলাম আরিফ টিপু (বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর) আহমদুল্লাহ চৌধুরী, মোঃ আনসার আলী (পরবর্তীতে বিচারপতি), মহসিন প্রামানিক, আবুল কালাম চৌধূরী, এসএমএ গাফ্ফার, হাবিবুর রহমান, আববাস আলী, মোশারফ হোসেন আখুঞ্জিসহ অনেকেই।
মে মাসে জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং জুন মাসে কলেজ ভিত্তিক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
১৯৫০ সালে রাজশাহীতে প্রথম প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার প্লাট ফরম ‘দিশারী সাহিত্য মজলিশ’ গড়ে উঠে। ডাঃ আব্দুল গাফ্ফারের নেতৃত্বে আন্দোলনে নতুন নেতৃত্ব শুরু হয় ওই সময়।
১৯৫০ সালে নাচোল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ ও সাঁওতাল বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই সব আন্দোলনের অগ্নিকন্যা ইলা মিত্রের প্রতি পাক মুসলিম লীগ সরকারের নির্দেশে পুলিশ অকথ্য নির্যাতন চালায়। ওই বছর রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ঐতিহাসিক খাপড়া ওয়ার্ডের অন্যায়ের প্রতিবাদে অনশনরত বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবর্গের উপর চলে অমানসিক নির্যাতন ও পুলিশের বে-পরোয়া গুলি বর্ষণ। পুলিশের গুলিতে সাতজন বীর দেলোয়ার, কম্পরাম, হানিফ, সুখেন, বিজন, আনোয়ার ও সুধীন ধর শহীদ হন। এই ঘটনায় রাজশাহীর ছাত্র, যুবক ও সচেতন মানুষ অগ্নিগিরির মত বিস্ফোরন্মুখ হয়ে উঠে। ১৯৫২’তে ঘটে তার বহিঃপ্রকাশ।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে পতাকা দিবস ও স্কুল কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়। কাগজে ছাপানো ছোট পাকিস্তানী পতাকা তৈরী করে তাতে লেখা হয় “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজশাহীর ভূবনমোহন পার্কে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মোঃ আনসার আলীর (পরবর্তীতে বিচারপতি) সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রাজশাহীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। জননেতা মাদার বক্স, জননেতা আতাউর রহমান, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, অধ্যাপক একরামুল হক, মোহাম্মদ সুলতান (পরবর্তীতে বিচারপতি), বীরেন্দ্রনাথ সরকার, আব্দুস সাত্তার মাষ্টার, অ্যাডভোটেক মজিবুর রহমান, সাংবাদিক সাঈদউদ্দিন আহমেদ, মনোয়ারা বেগম, রাজশাহী কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্র আনোয়ারুল আজিম, মমতাজ উদ্দিন (পরবর্তীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রফেসর ও বিশিষ্ট নাট্যকার), বেগম জাহানারা, হাফিজা বেগম টুকুসহ অনেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এরপর থেকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি চলতে থাকে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা যখন ভাষার দাবীতে উত্তাল। সে সময় রাজশাহীর ঐতিহাসিক ভূবনমোহন পার্কে চলছিল ভাষার দাবীতে জনসভা। সভা চলাকালে সন্ধ্যার আগে খবর আসে ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিতে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। মারা গেছেন অনেকেই। তখনই বক্তৃতাকালে আব্দুস সাত্তার মাষ্টার চিৎকার দিয়ে বলেন উঠেন “নুরুল আমিন তুমি কত রক্ত চাও ? দরকার হলে আমরা গ্যালনে গ্যালনে রক্ত দেব”।
আন্দোলনকারীরা ওই রাতেই রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের সামনে ইঁট ও কাদা-মাটি দিয়ে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার তৈরী করেন। সকাল ৭ টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা উদ্বোধন করা হয় এবং ছবি তুলে রাখা হয়। সকাল ১০ টার দিকে কর্মসূচি অনুযায়ী যখন ছাত্ররা হরতালে পিকেটিং করার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, তখন পুলিশ শহীদ মিনারটি গুড়িয়ে দেয়। একুশ পালনের পর ২২ ফেব্রুয়ারী রাজশাহীতে হরতাল ডাকা হয়। আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকে কালো ব্যাচ ও মাথায় কাপড় দিয়ে খালি পায়ে মিছিল করেন এবং ভুবনমোহন পার্কে সভা করেন। ১৯৬২ পর্যন্ত যথারীতি ভাষা আন্দোলন চলতে থাকে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আরো গতিশীল হওয়ায় একুশ উদ্যাপনও চলতে থাকে যথা নিয়মে।
লেখক, এস এম আববাস, সাংবাদিক।
ঢাকা জার্নাল, ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০১৩, তথ্য সূত্র :রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলন স্মারকপত্র। প্রথম প্রকাশ যুগান্তর, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮।