সুশীল সমাজের মামুরা কই?
ঢাকা জার্নাল: রানা প্লাজা ধস বা তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর সারা বিশ্বের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, পণ্য বয়কটের হুমকি কোনোটিই বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে না। রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের চাপই পারে শ্রমিকদের অবস্থার সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটাতে।
বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীতে ছাপা হওয়া এক নিবন্ধের শুরুতে এ কথাগুলো লেখা উল্লেখ করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ভন ড্রেহল।
টাইমের, মের ২০ তারিখের সংখ্যায় ‘ওয়ার্কড টু ডেথ’ শিরোনামে ছাপা হয় ওই নিবন্ধ।
ডেভিড ভনের ওই কয়েকটি লাইনেই প্রচ্ছন্ন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলোর চরিত্র আসলে রাজনৈতিক। রাজনীতিবিদরা ইচ্ছা করলেই পোশাক শ্রমিকদের এ সমস্যা সমাধান হতে পারে। আর রাজনীতিবিদদের বাধ্য করতে পারেন একমাত্র এদেশেরই জনগণ।
নিবন্ধে ডেভিড ভন উল্লেখ করেছেন “বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজের জন্য মরে।”
কথাগুলো নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া মৃতদেহ কিংবা তাজরীনে পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের গলিত লাশের সারি যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন তা অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে কি?
আসলে দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা এত বেশি জর্জরিত, কাজের পরিবেশ সম্পর্কে ভাবার অবকাশ তাদের নেই। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটানোর চিন্তায় তারা ভুলে যান, তাদের কর্মস্থলটি রানা প্লাজার মতো কোনো মৃত্যুগুহা নাকি তাজরীনের মতো কোনো অগ্নিকূপ?
স্বার্থপর সমাজও নিজের সুবিধাবাদিতা আড়াল করতে শ্রমিকের এই ক্লেশ চেপে যায় বেমালুম। ফলে ঘটে চলে সাভারের রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনা।
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের অবস্থা বিশ্লেষণ করে তাদের এ দুর্দশার জন্য রাজনীতিবিদদের উদাসীনতাকেই দায়ী করেন ডেভিড ভন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের একটি ‘বিখ্যাত’ উদ্ধৃতিকে।
“আমি এটাকে মারাত্মক কিছু মনে করি না, এটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা”। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে যখন ৫শ’তম মৃতদেহটি বের করা হচ্ছিলো, ঠিক তখনই দেশ বিদেশের গণমাধ্যমের সামনে এমন মন্তব্য করে বসেন বাংলাদেশের ‘বিজ্ঞ’ অর্থমন্ত্রী।
রাজনীতিবিদদের এই ঔদাসীন্যের অবসান ঘটিয়ে তাদের টনক নড়াতে পারে কেবল মাত্র জনগণ। এ প্রসঙ্গে ডেভিড ভন তার নিবন্ধে গত শতাব্দীর প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে আনেন।
এক শতাব্দী আগেও পশ্চিমা দুনিয়ার শিল্প কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার অনুরূপ ছিলো।
ডেভিড ভন লিখেছেন, একটা সময় ছিলো যখন লন্ডন, প্যারিস কিংবা নিউইয়র্ক শহরেও এমন ঘটনা (শ্রমিক হতাহতের) অহরহ ঘটতো। বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে অনিরাপদ কারখানা কিংবা খনিতে লাইন ধরেই কাজ করতে আসতেন পশ্চিমা বিশ্বের শ্রমিকরা।
১৯১০ সালের দিকেও কাজ করতে গিয়ে গড়ে প্রতিদিন আনুমানিক একশ’ শ্রমিক প্রাণ হারাতেন যুক্তরাষ্ট্রে। এদের কারও কবর হতো ধসে পড়া খনির অতল গহ্বরে, কেউ দ্বিখণ্ডিত হতেন ছুটে আসা করাতের ব্লেডে, আবার কেউবা কারখানার বিস্ফোরিত বয়লারের সঙ্গেই ছিন্ন ভিন্ন হতেন।
কিন্তু ১৯১১ সালে সংঘটিত একটি বিশেষ ঘটনার পর নাটকীয়ভাবে সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটে। উন্নত হয় কারখানার কর্মপরিবেশ। তাই আমেরিকার জনসংখ্যা আজ তিনগুন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কমে গেছে প্রায় ৯০ শতাংশ।
ওই সময় এমন কি ঘটেছিলো যা পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন আনলো?
১৯১১ সালে তাজরীনের মতই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে নিউইয়র্কে ট্রায়াঙ্গল নামের একটি ব্লাউজ তৈরির কারখানায়। প্রাণ হারান ১৪৬ নারী শ্রমিক,যাদের অধিকাংশই ছিলেন অল্প বয়সী তরুণী।
আজকের বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর মত তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক কারখানাগুলোতেও ঠাসাঠাসি পরিবেশে কাজ করতে হতো শ্রমিকদের।
কিন্তু ওই দুর্ঘটনার পরপরই নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ। ফলে আমূল পরিবর্তন আসে শিল্প কারখানার কর্মপরিবেশে।
প্রশ্ন হলো, ট্রায়াঙ্গলের আগুনের পর কেন রাতারাতি মার্কিন কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটেছিলো?
একটা উত্তর হতে পারে যে, ট্রায়াঙ্গলের ঘটনার পর শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। কিন্তু সে তো বাংলাদেশের আশুলিয়া কিংবা কাচপুরের শিল্পশ্রমিকরাও রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই নেমে আসছেন।
আসলে পার্থক্য হলো ট্রায়াঙ্গলের আগুনের পর সেদিন শ্রমিকদের সমর্থনে রাস্তায় নেমে এসেছিলো নিউইয়র্কের সাধারণ জনগণ, যাদের সম্মুখ সারিতে ছিলেন সমাজের প্রগতিশীল এবং মধ্যবিত্ত অংশ। ফলে সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি ওই চাপ উপেক্ষা করা।
ওই ঘটনার নজির টেনেই ডেভিড উপসংহার টেনেছেন, একমাত্র রাজনীতিবিদদের ওপর সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের চাপই পারে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘব করতে।
১৯০৯ সালেও একবার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকরা। আর নারী শ্রমিকদের এ আন্দোলনে সমর্থন দেয় তখনকার প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত সমাজ। পাশাপাশি নারীর ভোটাধিকারসহ অন্যান্য অধিকার আদায়ের জন্য মাঠে নামা নারীবাদীরাও শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
তখনই ওই আন্দোলন ভিত নাড়িয়ে দেয় নিউইয়র্ক শহরের তৎকালীন ক্ষমতার আধার টামানি হলের। (টামানি হল যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী যারা নিউইয়র্কের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতো)।
ফলে ১৯১১ সালে ট্রায়াঙ্গলের আগুনের পর যখন আবারও শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন তখন আর শ্রমিকদের দাবিকে উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না সরকারের পক্ষে।
আবারও এ সময় শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়ান মধ্যবিত্ত সমাজ ও সংস্কারবাদীরা। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে আসেন তারা।
এতদিন টালবাহানা করলেও এবার নিজের করণীয়ও ঠিকই বুঝে ফেললেন টামানি হলের ধুরন্ধর প্রধান চার্লস মারফি।বুঝে গেলেন নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার্থে হয় এ জন জাগরণের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে, না হলে নিক্ষিপ্ত হতে হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েতে।
বিচক্ষণ মারফি প্রথম উপায়টিই বেছে নিলেন। শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্দেশ্যে কাজে লাগালেন তরুণ কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল দুই রাজনীতিবিদ আলফ্রেড ই.স্মিথ ও রবার্ট ওয়াগনার সিনিয়রকে। রাজনৈতিক উপায়েই শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করতে সমর্থ হন তারা।
ওই ঘটনার নজির টেনে ডেভিড ভন বলেন, গত মে দিবসেও মাঠে নেমে এসেছিলেন বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের একটি বড় অংশ। কিন্তু তারা কি সমাজের সুশীল অংশ কিংবা মধ্যবিত্ত সমাজকে পাশে পেয়েছিলেন?
ডেভিডের মতে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন ঘটেছিলো কারণ আন্দোলনকারী শ্রমিকরা সমাজের প্রভাবশালী অংশের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিলেন।
তাই আজ বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে এ দেশেরই মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষদের। তারাই পারবেন নিজস্ব ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টিতে।
মূলত সারা বিশ্বেই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোকে নিজেদের পকেটে রাখে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো। সরকারকে বিভক্ত ও অকার্যকর করে রেখে নিজেদের কোটারি স্বার্থ নিশ্চিত করে তারা। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে কেবল সংস্কারবাদীদের মিলিত শক্তি। ডেভিডের মতে তারা একত্রিত হলেই কেবল পরিবর্তন সম্ভব, অন্যথায় নয় ।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন ডেভিড ভন। তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমাজে সব ধরণের অসঙ্গতির পেছনে মূলত দায়ী দুর্নীতি। কিন্তু একমাত্র আইনের শাসনই পারে এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে।
ডেভিডের মতে পুরোপুরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হলেও অন্ততপক্ষে ন্যুনতম ন্যায্যতাই পরিস্থিতিকে অনেকখানি বদলে দিতে পারে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে আসলে পুরো সমাজই নিরাপদ ও সমৃদ্ধ হয়। পরোক্ষভাবে লাভবান হন সবাই।
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশি তৈরি পোশাক পণ্যের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং অনেক ক্রেতার বাংলাদেশি পণ্য না কেনার সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে ডেভিড ভন উন্নত বিশ্বের ওই সব ‘সচেতন ব্যক্তিদের’ সমালোচনা করে বলেছেন, উন্নত বিশ্বের ভোক্তারা হয়তো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কেনা কমিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ওই দরিদ্র শ্রমিকরাই।
তাই শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো, তাদের বর্জন নয়।
ট্রায়াঙ্গলের আগুনের পর নিউইয়র্কবাসী যেভাবে শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
আর এক্ষেত্রে খুবই জরুরি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং সুশীল ও প্রগতিশীল অংশের মানুষের অংশগ্রহণ।
ঢাকা জার্নাল, জুন ০৭, ২০১৩