ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো
ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে কতিপয় চক্রান্তকারী-উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য। সেসময় সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ওই ঘটনার কয়েক মাস আগে কর্নেল জিয়াকে কূটনীতিকের দায়িত্ব দিয়ে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার।
কিন্তু জিয়ার জোর লবিং এর কারণে পরবর্তীতে তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। তাকে বিদেশে পাঠানো গেলে ১৫ আগস্টের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত।
লে. কর্নেল (অব.) এমএ হামিদের ‘থ্রি আর্মি ক্যুস অ্যান্ড সাম আনটোল্ড টেইলস’ অবলম্বনে সেসব ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সরকারের প্রতি জিয়ার আনুগত্য নিয়ে সরকারের মধ্যে প্রশ্ন ছিল। জিয়াকে ডেপুটি চিফ বানানোর পরও আর্মিতে তার ভূমিকা যথেষ্ট ছিল না। বঙ্গবন্ধু ও সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতারা জিয়াকে খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসার বলে অভিহিত করেন।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থকে স্বাধীনতা ঘোষণাকালে জিয়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসার স্বপ্নের কথা জানান। ১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন মেজর জিয়া।
এসব কারণে সরকার জিয়াকে ‘সিভিল পোস্টিং’ এ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাকে পূর্ব জার্মানি অথবা বেলজিয়ামের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
সরকারের এমন সিদ্ধান্ত জিয়াকে চিন্তায় ফেলে দেয়। তিনি এজন্য তৎকালীন জেনারেল এমএজি ওসমানি, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল খালেদ মোশাররফকে দায়ী করেন।
শেখ মুজিবের খুবই কাছের লোক ছিলেন খালেদ মোশাররফ। তিনি প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। ধারণা করা হয়েছিল, তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত হবেন।
এ পরিস্থিতিতে জিয়া তাকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কার্যকরের আগেই লবিং শুরু করে দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত তার সামরিক ক্যারিয়ার শেষ করে দেবে। তাই কাছের বন্ধু তৎকালীল ঢাকা ক্যান্টনমেনেটর স্টেশন কামান্ডার লে. কর্নেল এমএ হামিদের কাছে ধরনা দেন।
তিনি এমএ হামিদের উদ্দেশে বলেন, দয়া করে, ওসমানির সঙ্গে দেখা করে আমার জন্য কিছু করো। অন্যথায় আদেশ কার্যকর হয়ে যাবে।
হামিদের সঙ্গে প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাইদুর রহমানের সঙ্গে আবার আ’লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের ভালো খাতির ছিল। সাইদুরের সঙ্গে দেখা করে জিয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেন হামিদ। এসময় হামিদ সাইদুরের কাছে জিয়াকে পেট্রোবাংলার প্রথম চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমানের ছোটভাই বলে পরিচয় দেন।
অনেক চেষ্টার পর তোফায়েলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান জিয়া। বলে রাখা ভালো, তোফায়েল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। এরপর জিয়া বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে সমর্থ হন যে সরকারের প্রতি তার আনুগত্য আছে। এরপর তাকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৫ আগস্টের পর জিয়া ধীরে ধীরে রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিতে পরিণত হন। হামিদের উদ্দেশে ৭৫’র মুশতাক সরকারের প্রধান নাটের গুরু মেজর রশিদ বলেন, জিয়া যেকোনো মূল্যেই প্রেসিডেন্ট হতে চান। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য তার বয়স খুব কম ছিল এটা আমি তাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাকে ধৈর্য্য ধরতে বলেছিলাম। আর্মি চিফ হিসেবে তিনি ভালো ছিলেন।
হামিদকে রশিদ বলেন, জিয়া নাছোড়বান্দা ছিল। অবেশেষ ১৯৭৭ সালের ২ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৪১ বছর।
এরপর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। একের পর এক সংবিধান পরিবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধের দোসর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতিতে আনেন।
এর কয়েক বছর পর এসব বিষয়ে সাইদুর রহমান হঠাৎ একদিন ফোন করে কর্নেল হামিদকে বলেন, “কর্নেল, ১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বর এই তিনটি সামরিক অভ্যুত্থানই তোমার কারণে হয়েছে। হামিদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে জবাব দেন, আপনি জিয়াউর রহমানকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করতে আমাদের ব্যবহার করেছেন। এটি আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি জিয়া বিদেশে থাকতো তাহলে এর একটি অভ্যুত্থানও হতো না।
লে.কর্নেল (অব.) এমএম হামিদের থ্রি আর্মি ক্যুস এন্ড সাম আনটোল্ড টেইলস অবলম্বনে। সৌজন্যে: দ্য ডেইলি স্টার – See more at: https://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/315212.html#sthash.8aJw4Du5.dpuf