হাসান আলীর ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড
ঢাকা জর্নাল: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। হাসান আলীর বিরুদ্ধে আনা ছয়টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ এ দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ জুন) এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
তবে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, সরকার ইচ্ছা করলে হাসান আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা তাকে গ্রেফতার করার পর গুলি করে (ফায়ারিং স্কোয়াড) হত্যার মধ্য দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করতে পারে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ দুই প্রক্রিয়ার যেকোনো একটি অবলম্বন করা সরকারের ইচ্ছাধীনও করা
হয়েছে রায়ে।
এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার কোনো রায়ে সরকার যেটা সুবিধাজনক মনে করে সেভাবেই রায় কার্যকর করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া পলাতক হাসান আলীকে গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আইজিপিকে নির্দেশ দিয়ে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
তাড়াইলের ‘রাজাকারের দারোগা’ নামে পরিচিত হাসান আলীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুট, আটক ও নির্যাতনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)/এ, ৩(২)/সি, ৩(২)/ডি, ৩(২)/জি ও ৩(২)/এইচ এবং ২০(২) ধারা অনুসারে গঠন করা এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।
এর মধ্যে পাঁচটি অর্থাৎ ২ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং একটি অর্থাৎ ১ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে দু’টি ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন হাসান আলী। বাকি তিনটি ২, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ। প্রমাণিত না হওয়া ১ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
বেলা সোয়া ১১টা থেকে বেলা ১২টা ১২ মিনিট পর্যন্ত ১২৫ পৃষ্ঠার রায় পাঠ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের অপর সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। সবশেষে রায়ের চূড়ান্ত অর্থাৎ সাজার অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
রায় পড়ার আগে সূচনা বক্তব্যেও পলাতক আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন ট্রাইব্যুনাল। বেলা ১১টা ১১ মিনিটে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এজলাসে ওঠেন। এরপর চার মিনিটের সূচনা বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, আসামি গ্রেফতারে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা আসামি গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। তারপরও আসামি গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
এজন্য আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দিতে হচ্ছে বলেও জানান এম ইনায়েতুর রহিম।
আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শও দেন ট্রাইব্যুনাল।
উপস্থিত প্রসিকিউশন টিম এবং সাংবাদিকদেরও রায়ের আগে ধন্যবাদ জানান ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান।
রায়ে বলা হয়েছে, পিতা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোসলেম উদ্দিনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে কিশোরগঞ্জ মহকুমার তাড়াইল থানায় রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত হন সৈয়দ হাসান আলী। তার অন্য এক ভাইও রাজাকার ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রাস ছিলেন রাজাকার হাসান আলী। তিনি অন্যান্য সহযোগীসহ তাড়াইল থানার বিভিন্ন এলাকাসহ কিশোরগঞ্জে নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জোর করে টাকা আদায় ও ধর্মান্তরিতকরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তার নির্দেশেই তাড়াইলে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে।
রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন তিনি।
হাসান আলীদের মূল বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের পর কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে না থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা গ্রামে বসবাস করতেন হাসান আলী।
দুই গণহত্যায় মৃত্যুদণ্ড
হাসান আলীর বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ে দুই অভিযোগ মিলিয়ে মোট ২০ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ১০ জনকে অপহরণ-নির্যাতন এবং ১০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ৩ নম্বর অভিযোগে তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ার অক্রুর পালসহ ১২ জনকে হত্যা এবং ১০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে ভোরগাঁও গ্রামের বেলংকা রোডে সতিশ ঘোষসহ ৮ জনকে হত্যা ও ১০ জনকে অপহরণ ও লুটপাটের অপরাধ প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে।
প্রমাণিত তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ার অক্রুর পালসহ ১২ জনকে হত্যা এবং ১০টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে। ঘর থেকে পুরুষরা বের হওয়ার পর তাদের ধরে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেন হাসান ও সহযোগীরা। যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন- অক্রুর চন্দ্র পাল, শরৎ চন্দ্র পাল, সুরেশ চন্দ্র পাল, উপেন্দ্র চন্দ্র পাল, গোবিন্দ চন্দ্র পাল, ধরনী চন্দ্র পাল, যোগেশ চন্দ্র পাল, দীনেশ চন্দ্র পাল, যতীন্দ্র চন্দ্র পাল, রাখাল চন্দ্র পাল ও মোঃ সুরুজ আলী।
প্রমাণিত চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ সেপ্টেম্বর সোমবার তাড়াইল থানার ভোরগাঁও গ্রামের বেলংকা রোডে সতিশ ঘোষসহ ৮ জনকে হত্যা ও ১০ জনকে অপহরণ ও লুটপাটে নেতৃত্ব দেন হাসান আলী। ওই দিন ময়মনসিংহ জেলার (বর্তমান নেত্রকোনা জেলা) কেন্দুয়া থানার পাকুড়া গ্রামে ৮ জন পুরুষ ও ৪-৫ জন নারী ভারতে যাওয়ার জন্য নৌকাযোগে তাড়াইলে আসেন। নৌকার ৮ যাত্রীকে নিচে নামিয়ে এনে গুলি করে হত্যা করেন হাসান ও তার সহযোগীরা। নৌকার ছইয়ের ওপর থেকে আরও তিনজনকে নামিয়ে আনা হয়। যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন- মঞ্জু বালা ঘোষ, সুরেশ চন্দ্র ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণ চন্দ্র ঘোষ শিবু, সুকুমার ঘোষ, রুহিনী চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
চারজনকে হত্যায় আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ
২, ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে আরও চারজনকে হত্যা, দুইজনকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন এবং ১০৬টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে হাসান আলীকে। এর মধ্যে ২ নম্বর অভিযোগে কোনা ভাওয়াল গ্রামের শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়াকে হত্যা করে দু’টি ঘরে লুণ্ঠন, দুইজনকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন, ৫ নম্বর অভিযোগে আড়াইউড়া গ্রামের চামেলী কুমার ঘোষের বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে কামিনী কুমার ঘোষ ও জীবন কৃষ্ণ ঘোষকে হত্যা ও ৬টি ঘরে লুটপাট এবং ৬ নম্বর অভিযোগে সাচাইল গ্রামের রাশেদ আলী বেপারীকে হত্যা ও একই সঙ্গে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের দায় প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
প্রমাণিত দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৩ আগস্ট তাড়াইল থানার বাড়তি ইউনিয়নের কোনা ভাওয়াল গ্রামের শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়াকে হত্যা করে দু’টি ঘরে লুণ্ঠন এবং দুইজনকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতন করেন হাসান আলী।
প্রমাণিত পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৮ অক্টোবর শুক্রবার তাড়াইল থানার তাল জাঙ্গলা ইউনিয়নের আড়াইউড়া গ্রামের চামেলী কুমার ঘোষের বসতবাড়িতে হামলা করে কামিনী কুমার ঘোষ ও জীবন কৃষ্ণ ঘোষকে হত্যা ও ৬টি ঘরে লুটপাট চালায় হাসান আলীর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী। রাজাকার বাহিনী জীবন কৃষ্ণ ঘোষের স্ত্রী মিলন রানী চক্রবর্তীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে তার ঘর থেকে সোনা রুপার অলঙ্কার লুট করে নেয়। এরপর জীবন কৃষ্ণ ঘোষকে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর রাজাকার হাসান আলীর নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাজাকার বাহিনী পরে কামিনী কুমার ঘোষকেও ধরে এনে নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে গুলি চালালে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে তিনি মারা যান।
প্রমাণিত ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর তাড়াইল থানার সাচাইল গ্রামের রাশেদ আলী বেপারীকে হত্যা ও একই সঙ্গে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন হাসান আলী। ওই দিন রাজাকার বাহিনীর ৪০-৫০ জন সদস্য আব্দুর রশিদের বাড়ি ঘেরাও করে। তারপর তাকে ধরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে হাসান আলীর নেতৃত্বে ওই গ্রামে লুটপাট চালানো হয়। ওই দিন ৬৪টি হিন্দু পরিবারের ১০০টি ঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এক অভিযোগে খালাস
তাড়াইল থানার সাচাইল গ্রামের হাচান আহম্মেদ হেচুকে গুলি করে হত্যা এবং হাসান আহমদ ওরফে হাসু বেপারীর ৭টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন হাসান আলী। এক নম্বর অভিযোগে আনা এ অপরাধ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে রায়ে এ অভিযোগে তাকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রমাণিত না হওয়া প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ এপ্রিল সহযোগী রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার সাচাইল গ্রামের হাসান আহমদ ওরফে হাসু বেপারীর ৭টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন তিনি। পরে হাচান আহম্মেদ হেচুকে গুলি করে হত্যা করেন।
ঢাকা জর্নাল, জুন ০৯, ২০১৫