‘স্তব্ধ’ সাংস্কৃতিক অঙ্গন দোষীদের বিচার দাবি
বৃহস্পতিবার বিকেল মানেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে শিশুদের মিলনমেলা, কোলাহল। একঝাঁক শিশু মাটিতে কিছু একটা বিছিয়ে তাতে বসে ছবি আঁকছে, চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্যই দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। তবে গতকালের বিকেলটা ছিল ‘অন্য রকম’। যেন সুনসান নীরবতা নেমেছে ভাষা চত্বরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিশু নাট্যমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নিয়াজ মোহাম্মদ খান বিটু জানান, শিশুদের বৃহস্পতিবার বিকেল ও শুক্রবার সকালের চিত্রাঙ্কন ক্লাস বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিসে হামলা হওয়ার পর ক্লাস নেওয়ার মতো পরিবেশ নেই। অফিসের যা অবস্থা তা শিশুদের দেখানো যাবে না। এতে শিশুদের মন ভেঙে যাবে।’ আজ সকালের কবিতার ক্লাস বাতিল করা হয়েছে তিতাস সাহিত্য-সংস্কৃতি পরিষদ ও তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের। এ দুটি সংগঠনের অন্যতম পরিচালনাকারী মো. মনির হোসেন ও বাছির দুলাল বললেন, ‘প্রতিবাদ হিসেবেই আমরা এ সপ্তাহের ক্লাস নিচ্ছি না। এ ছাড়া ক্লাস নেওয়ার মতো পরিবেশও নেই।’ তিতাস ললিতকলা একাডেমিতে গতকাল গানের আওয়াজ পাওয়া যায়নি। অথচ কি সকাল কি সন্ধ্যা প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের সুরের মূর্ছনায় মুখর থাকত একাডেমি অঙ্গন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অগ্রণী ভূমিকা রাখা তিতাস সাহিত্য একাডেমিতেও ধ্বংসস্তূপ। গতকাল কারো ‘কার্যকরী পা’ পড়েনি প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিষ্ঠানগুলো ভাষা চত্বরেই অবস্থিত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনেও গতকাল বেজে ওঠেনি কোনো গানের সুর। সুরের রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া অসুরের থাবায় এখন ‘প্রাণহীন’। যেন থমকে আছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন। সংস্কৃতিকর্মীরা এখন প্রায় বাকরুদ্ধ, চোখের কোণে পানি। এর আগে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এত বড় হানার ঘটনা ঘটেনি বলেই অভিমত তাদের। এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির দিকেই এগোচ্ছে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীরা। পাশাপাশি দোষীদের বিচার দাবি করে আইনের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। তবে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো প্রাণ ফিরে আসেনি। তাণ্ডবের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় বুধবার রাতে আরো তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট ১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অন্তত সাত হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে। তবে পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার ওসি মো. মফিজ উদ্দিন গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার করে আমরা হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে।’ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত সোমবার সংঘর্ষে মাসুদুর রহমান নামে পৌর এলাকার কান্দিপাড়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের মৃত্যু হলে এর জের ধরে মঙ্গলবার দিনভর শহরজুড়ে তাণ্ডব চালায় মাদ্রাসা ছাত্রসহ কিছু দুর্বৃত্ত। তাণ্ডবের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরিস্থিতি এখন শান্ত হয়ে এসেছে। গতকাল সকাল থেকেই পৌর এলাকার সব দোকাটপাট খুলতে শুরু করে। শহরে যানবাহন ও সাধারণ মানুষের চলাচল ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে জেলার সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশে মিলিত হয়। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নূরের সভাপতিত্বে ও তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক মো. মনির হোসেনের পরিচালনায় এতে বক্তব্য দেন জেলা নাগরিক সমাজ আহ্বায়ক তাজ মো. ইয়াছিন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো. হারুন অর রশিদ, সাহিত্য একাডেমির আহ্বায়ক কবি জয়দুল হোসেন, সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের সম্পাদক আবদুল মান্নান সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাট্য সংস্থার সম্পাদক মনজুরুল আলম, জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. অরুণাভ পোদ্দার, নাগরিক ফোরাম সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য প্রমুখ। বক্তারা মঙ্গলবারের নারকীয় ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিচার দাবি করেন। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ‘আইএস’-এর অর্থায়নে মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণের নামে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার অভিযোগ এনে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নাসিরনগর ডিগ্রি কলেজ মাঠে উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ আয়োজিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. রাফি উদ্দিন আহাম্মেদ। বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান এ টি এম মনিরুজ্জামান সরকার, দাঁতমণ্ডল এরফানিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মো. ইলিয়াস আল কাদরী, মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম প্রমুখ। ঢাকায় সাংস্কৃতিক জোটের বিক্ষোভ মিছিল : এদিকে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানিয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বিক্ষোভ সমাবেশে বিচারের দাবি জানানো হয়েছে।
সমাবেশ শেষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, নাট্যজন মান্নান হীরা প্রমুখ। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত বিদ্যায়তন, সাহিত্য একাডেমি ও মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থায়নে নির্মিত মার্কেটের ওপর হামলা কোনো আবেগতাড়িত ঘটনা নয়। এ ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংস্কৃতি সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলন ঘটায়, কিন্তু সংস্কৃতিকে তারা ধ্বংস করতে চায়। তিনি আরো বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের দেওয়া বিতর্কিত বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম বলেন, দেশ আজ সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। সংস্কৃতির ওপর হামলা এটিই প্রথম নয়, এর আগেও অনেকবার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বর্তমানে বিভিন্নভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে। তাদের হামলার পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে। তা না হলে কেন শুধু সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, দলীয় নেতাদের বাড়িতে হামলা হবে?