সোয়ান শ্রমিকদের জীবনসঙ্গী ডা: শাহজাহান
সঞ্জীব দাস: শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ শাজাহান, আশুলিয়া গার্মেন্ট শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের সাথী। ডাক্তার কিংবা কবিরাজির কোন কেতাবি ডিগ্রী তার নাই। নিজেকে এমন দাবিও করেন না, কিন্তু আঠারো দিন ধরে চলমান সোয়ান গার্মেন্ট শ্রমিকদের লাগাতার অবস্থান আন্দোলনে তিনি একনামে পরিচিত, ‘ডাক্তার শাজাহান ভাই’। সোয়ান শ্রমিকরা তাকে এই নামেই ডাকেন, কেউ কেউ বিশ্বাসও করেন যে, তিনি বড় ডাক্তার না হলেও একজন ডাক্তার।
সোয়ানের শ্রমিকরা আঠার দিন ধরে যে কঠিন সংগ্রাম করছে তা গার্মেন্ট শিল্পের ইতিহাসে নজীরবিহীন। একটানা এতদিন অবস্থান কর্মসূচী চালাতে গিয়ে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পরেছেন। বিশেষ করে বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলা এই আন্দোলনে ঠাণ্ডাজ্বর প্রায় সকলের। মুক্তি ভবনে শ্রমিকদের জন্য বেশীরভাগ সময় খিচুরি রান্না হয়, যা শ্রমিকদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বৃদ্ধি করছে। কম পানি খাওয়াসহ নানা কারণে শ্রমিকরা পেটের সমস্যাসহ আরও অন্যান্য সমস্যায় ভুগছেন। আন্দোলনে প্রগতিশীল চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস ফর হেলথ এন্ড এনভায়রমেন্ট ঔষধ ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের এই সকল সুবিধা অসুবিধায় হাসিমুখে নিবিড় পরিচর্যার কাজ করে যাচ্ছেন শাজাহান। নিয়ম করে প্রতিবেলায় শ্রমিকদের সমস্যা শুনছেন, চার ধরনের ঔষধ বিতরন করছেন, বেশী অসুস্থ হয়ে পরা শ্রমিকদের হাসপাতালে পাঠাচ্ছেন। এইকাজে তার কোনো বিরাম নেই, ক্লান্তিও নেই।
মোহাম্মদ শাজাহান গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নেতা, জানা গেল একসময় গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করলেও এখন তিনি সংগঠনের সার্বক্ষনিক কর্মী।
জানতে চাওয়ায় শাজাহান একজন সাধারণ শ্রমিক থেকে শ্রমিকদের প্রিয় নেতা হয়ে ওঠার গল্প বলতে শুরু করেন। “২০০৫ সালে আমি আশুলিয়া জামগড়ার সেফ ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল কারখানআয় হেল্পার হিসেবে যোগদেই, শিক্ষানবীশ মজুরি ছিল ৯০০ টাকা। এক বছরের মাথায় অপারেটর হয়ে যাই, ১৬৬২ টাকা বেসিক সবমিলিয়ে ২৪০০ টাকা হত।”
এভাবেই একজন গার্মেন্ট শ্রমিক হিসেবে তার জীবন শুরু। জানালেন তারা জামগড়ার স্থায়ী বাসিন্দা, পূর্বপুরুষের ভাল জায়গা জমি থাকলেও এখন তাদের পরিবারের সম্বল ৩ শতাংশ জায়গার ওপরে তিনের বসত বাড়ি। মা-বাবা, তিন ভাই এর মধ্য তিনি সবার বড়। বাবা নাইট গার্ড তিনি গার্মেন্ট শ্রমিক এই দুজনের আয়েই চলত তাদের সংসার। জানালেন, সবাই বলে ৮৮’র বন্যার সময় তার জন্ম। স্থানীয় গোরাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বললেন, আশুলিয়ায় শিল্প যত বাড়লো তাদের সচ্ছলতা তত কমেছে, যাদের অল্প যায়গা-জমি ছিলো তারা সেটা রক্ষা করতে পারে নাই। সংসারের অভাবের কারণে লেখাপড়া ছাড়েন এবং রান্না করে নিয়ে গিয়ে কারখানায় শ্রমিকদের খাওয়ানো শুরু করেন। এ কাজ করেছেন ৫ বছর। এরপর নিজেই শ্রমিক হিসেবে কারখানায় ঢুকে যান। এভাবেই শুরু।
২০০৯ সালে এক নারী সহকর্মীর বাসায় তার স্বামী জিয়ার মাধ্যমে প্রথম গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র নামের সাথে পরিচয়। জানতে চাই, ২০০৬ সালের গার্মেন্ট বিদ্রোহের সময় কি করলেন? “গেছি সব জায়গায়, রাস্তায় নামছি হাজার হাজার শ্রমিকের সাথে কিন্তু এলোপাথাড়ি ভাবে। কোন দিকনির্দেশনা ছিল না।” বললেন শাজাহান।
এর মধ্যেই একটু একটু করে আন্দোলনে হাতেখড়ি তার। জানালেন, তার কারখানায় যাদের ইউনিয়ন ছিল তারা সলিডারিটির কথা বললেও ভূমিকা রাখত শ্রমিকদের বিপক্ষে। শ্রমিকদের বিচার করত শাস্তি দিত। “একদিন মদিনা সোয়েটারে আন্দোলন হল, সেই দায়ে আমাকে সেফ ফ্যাশন থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল। দুনিয়ার মজদুর এক হও! স্লোগান দেই আমরা, কিন্তু আমার মনে হয় এতে মালিকদের ঐক্য আরও পোক্ত হয়। যাই হোক, মালিকে-মালিকে ঐক্যের শিকার হলাম প্রথমবারের মত। কিন্তু আমার কারখানার শ্রমিকরা আমার জন্য আন্দোলন করল, আন্দোলনে দালালদের পিটিয়ে বের করে দিল। আমি আবার চাকরি ফিরে পেলাম, তখন আমার মর্যাদা ও শক্তি আগের চেয়ে ওনেক বেশী।”
তিনি একটু হাসেন আর বলতে থাকেন, “ তখন ২০১০ সাল, আমাদের দাবি নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার টাকা। আন্দোলন চলল তুমুল একদিন রাতে আমার চাচা, যিনি বাজারের নাইট গার্ড, খবর নিয়ে আসলেন পুলিশ আমার ছবি দেখিয়ে বাড়ির খোজ করছে। আমাদের বাড়ি এখনো গারমের মত বাশঝাড় আছে, আমি দ্রুত পালালাম। ঐবছর সবেবরাতের এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। এই যে বাড়ি ছাড়তে হল, ছয় মাস আত্মগোপনে ছিলাম। আমরা আত্মগোপন করেছিলাম পুলিশের কাছ থেকে কিন্তু শ্রমিক এবং আন্দোলন থেকে নয়। দুই একজন অবশ্য আন্দোলন থেকেই পালিয়ে গেল। প্রথমে মোহাম্মদপুরের দিকে জলি আপার পরিচিত কারো বাসায় থেকে গোপনে এলাকার শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ হত। একদিন পুলিশ আমার সন্ধান চেয়ে আমার মামা কে খুব নির্যাতন করল। মা কে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল, তিন দিন থানায় আটক রাখল, আমি যাতে ধরা দেই। তারপর আমার মা কে চালান করে দিল, ৬ দিন পরে জামিন হল। এর মধ্যে আমাদের আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি শ্রমিকনেতা তুহিন চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে গেল। পরিস্থিতি বেশী খারাপ হয়ে যাওয়ায় চার মাস বিভিন্ন যায়গায় লুকিয়ে থেকে সংগঠনের নির্দেশ পালন করতে থাকি। কোরবানির ঈদের আগের রাতে বাড়ি ফিরি, পরের ছয় মাস এলাকায় থাকলেও বাড়িতে থাকা হয় নি।” শ্রমিকনেতা শাজাহানের এভাবেই শুরু। এর পর ৪৪০০ টাকা মোট বেতনে জিয়ন গার্মেন্টে তিন মাস, ৪৫০০ টাকা মোট বেতনে ভি-রোজ গার্মেন্টে চার মাস কাজ করেছেন। কাজের যা চাপ তাতে কারখানায় চাকরি করে সংগঠন করা কঠিন হয়ে পরে, তাই চাকরি ছেড়ে এক পর্যায়ে ছোট একটি দোকান দিয়েছিলেন। জামগড়ায় সংগঠনের অফিস নেয়া হল, খুব ভালই চলছিল। এর মধ্যে শুরু হল খাবারের টাকা নিয়ে আন্দোলন, আশুলিয়ায় সর্বত্র এ আন্দোলন ছড়িয়ে পরল। ফলাফল সেতারা গ্রুপে নেতৃস্থানীয় শ্রমিকরা ছাটাই হল। আর মাস্তানরা হামলা করে অফিস ভাঙচুর করে তুলে দিল। অফিস থেকে আধা কিলোমিটার দূরে আমার দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেল। “পারলে আমাকে দেশ থেকেই বের করে দেয়। এটা বুঝলাম লড়াই সংগ্রাম এবং সাজানো গোছানো জীবন এক সাথে হবে না।” তিনি যখন একথা বলেন, তার কন্ঠে ওন্যরকম এক শক্তির আভাস পাই।
জানতে চাই, চলেন কিভাবে? জানালেন, দোকান তুলে দেয়ার পর আর কোন কাজ নেননি, এর পর সংগঠনের সিদ্ধান্তে সার্বক্ষনিক রাজনীতি করার জীবন বেছে নিয়েছেন। সংগঠনের সামর্থমত ভাতা পান। বিয়ে করবেন কিনা এ প্রশ্ন করায় লাজুক হেসে বললেন, কিছু সমন্ধ আসে কিন্তু ছেলে কি করে এই প্রশ্নের উত্তরে তার সন্তুষ্ট হন না। জানালেন এটা বড় সমস্যা নয়, তার পার্টির দুইএকজন উচ্চশিক্ষিত বড় নেতারাও এমন পরিস্থিতিতে পরেন। শ্রমিক হওয়ায় তাদের চেয়ে তার অবস্থা সুবিধাজনক।
ডাক্তার শাজাহান শুধু ডাক্তারিই নয় সমাবেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময় স্লোগান দিয়ে বক্তব্য রেখে আন্দোলনরত সোয়ান শ্রমিকদের উজ্জীবিত রেখেছেন। আবার খাবার সময় শত শত শ্রমিককে সুশৃঙ্খল ভাবে খাবার পরিবেশন করছেন। তার কোন ক্লান্তি নাই, বিশ্রাম নাই, সদা হাসি মুখ। এভাবেই শাজাহানদের মত আরও অনেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন সোয়ান গার্মেন্ট এর শ্রমিক আন্দোলন এবং এদেশের শ্রমিক মেহনতি মানুষের লড়াই সংগ্রামের।
ঢাকা জার্নাল, জুলাই ২৯, ২০১৫।