মত-অমত

সুস্থ কর্ম পরিবেশই পোশাক খাতের চ্যালেঞ্জ-কে সুযোগে পরিণত করবে  

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

পোশাক খাতের অস্থিরতা কাটছেই না। নতুন করে অশান্ত হচ্ছে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল। গতকাল সোমবার আশুলিয়ায় সড়ক অবরোধ,বিক্ষোভ ও কর্মবিরতি পালন করেন বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। কয়েকটি কারখানায় হামলার ঘটনাও ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের ৫১টি পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় মালিক কর্তৃপক্ষ। গাজীপুরেও একটি কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ৪ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন।

ইতোমধ্যেই এ অস্থিরতায় ১০-১৫ শতাংশ সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে গেছে। কয়েকটি দেশ এই সুযোগকে ব্যবহার করে ক্রেতাগোষ্ঠীকে টানার চেষ্টা করছে। মাঝে একটু পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে সোমবারের শ্রমিক বিক্ষোভ নতুন করে শংকা তৈরি করেছে।

এমন পরিস্থিতিতে এই শিল্পে বিরাজমান অস্থিরতা ও সমস্যা নিরসনে সরকারের কাছে ১৮টি দাবি উত্থাপন করেছে শ্রমিক পক্ষ। সোমবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘গার্মেন্টস শিল্প সেক্টরে সৃষ্ট শ্রম অসন্তোষ বিষয়ক শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিদের সাথে সভায়’ এসব দাবি উত্থাপন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। শ্রম আইন সংশোধনসহ এসব দাবির দুটি উল্লেখযোগ্য দাবি হলো, মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনপূর্বক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করতে হবে এবং যে সব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ও এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রমিকরা দাবি করেছেন, মজুরি পুনর্নির্ধারণের সাথে বাৎসরিক ন্যূনতম ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিতে হবে।

কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিল্পের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে কী সহসা এসব দাবি মানা সম্ভব? সোমবারেই মালিকপক্ষের সংগঠন বিজিএমইএ এক জরুরি বৈঠকে বসে দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বরং তারা বলেছেন, কারখানায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে না পারলে বিজিএমইএর সব সদস্য সম্মিলিতভাবে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি,শিল্পের অক্ষমতা এবং উৎপাদনের খরচ যেভাবে বেড়েছে তাতে করে শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন কাজ।

বোঝা যাচ্ছে একটা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে এ শিল্পের মালিক-শ্রমিকরা। দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ দেখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও। কিন্তু শুধু এটুকু বললে তো পরিস্থিতি সামলে নেয়া সম্ভব হবে না।

একটা কথা আমরা সবাই জানি পোশাক খাত ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা যাবে না। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। তাই এ খাতে অস্থিরতাকে গুরুত্ব দিয়েই দেখতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা পোশাক খাত এত বড় হয়েয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ শিল্পে গড়ে উঠেনি কোন বৈধ ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। ফলে নিয়মতান্ত্রিক দর-কষাকষির ব্যবস্থা পোশাক খাতে নেই। তাই আন্দোলনও আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয় না।

পোশাক খাতে সহিংসতার একটি বড় কারণ ঝুট ব্যবসা। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। পোশাক মালিকেরা অনেক কম দামে ঝুট কাপড় রাজনৈতিক মাস্তানদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এত দিন এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত আওয়ামী লীগের লোকজন,এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপির লোকজন। অথচ ঝুট কাপড়ের ন্যায্য দাম পেলে সেই অর্থ শ্রমিকদের কল্যাণেই ব্যয় করা যেত। কিন্তু তা হচ্ছে না। এর একটি সমাধান দরকার। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে এ সমস্যার সমাধান করে দিতে হবে অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে।

নিয়ম মাফিক বেতন ভাতা দিলে নিশ্চয়ই শ্রমিকরা রাস্তায় নামবে না। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধসহ শ্রমিকরা যে ১৮ দফা দাবি দিয়েছে,তা বাড়তি চাপে ফেলবে কারখানা মালিকদের।

সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বড় ধরনের ধাক্কা খায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। তবে নানামুখী উদ্যোগের কারণে বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়ায়। করোনাভাইরাস মহামারীতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েও সামলে উঠেছিল। এখন আবার নতুন করে শংকায় দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের খাতটি। অন্যান্য দেশের তুলনায় সস্তা শ্রম,কোটা পাশাপাশি সরকারি সুবিধা অর্থাৎ শুল্কমুক্ত আমদানি, ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা,ব্যাক-টু-ব্যাক এল সি,বন্ডেডওয়্যার হাউজ সুবিধা ও সংরক্ষিত বাজারের আকর্ষণে দ্রুত প্রসার লাভ করে এ খাত। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের আগে শুরু করলেও আশির দশকের শুরুতে গৃহযুদ্ধের কারণে পিছিয়ে পড়ে। তখন উন্নত দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশকেই ভালো বিকল্প হিসেবে বেছে নেয়। ফলে তরতর করে বাড়তে থাকে পোশাক রপ্তানি।

আমরা কী পারব তা ধরে রাখতে? এখন বড় প্রশ্নই এটাই। শ্রমিকদের দায়িত্বশীল ভুমিকা রয়েছে। অস্থিরতা, ভাংচুর করে কোন দাবিই আদায় হয়না। হলেও আখেরে তা মঙ্গলজনক হয় না কারও জন্যই। বিপরীতে মালিক পক্ষেরও মনোভাব বদলাতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় জোর দিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন,হয়রানি বন্ধ,ছাঁটাইয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। না হলে বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সুনাম কখনই বাড়বে না। তাতে পরোক্ষভাবে হলেও রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে মালিকপক্ষের উদ্যোগ লাগবে। আর এর মাধ্যমেই একটি সুস্থ পরিবেশ ফিরবে এই শিল্পে। মনে রাখা দরকার মালিক শ্রমিক সংসম্পর্ক আর সুস্থ কর্মপরিবেশই এ খাতের চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করবে।

লেখক: সাংবাদিক