Leadসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

সুন্দরবনে পণ্যবাহী নৌচলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশ

ভবিষ্যতে এ দুর্ঘটনায় বনের ক্ষতি এড়াতে সংরক্ষিত এলাকায় পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।

কমিটির প্রধান সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেন শুক্রবার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাঈদুল ইসলামের কাছে এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

ডিএফও মো. সাঈদুল ইসলাম  বলেন, “প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। এতে কার্গো মাস্টার ও ইঞ্জিন ড্রাইভারের গাফিলতি ও অদক্ষতাকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সংরক্ষিত এলাকায় নৌ চলাচল বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

৫১০ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহনের ক্ষমতা পুরনো ওই জাহাজের আছে কি না- সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

মংলা বন্দরের হারবাড়িয়া-১ থেকে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে যশোর যাওয়ার পথে মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে সুন্দরবনের বিউটি মার্কেট এলাকায় খাদ্য গুদামের সামনে পশুর নদীতে ডুবে যায় লাইটার কার্গো জাহাজ এমভি জি আর রাজ। দুর্ঘটনার পর জাহাজের মাস্টার ও নাবিকরা সাঁতরে তীরে ওঠেন।

ওই ঘটনায় জাহাজ মালিক দিল খান ও মাস্টার বুলু কাজীর বিরুদ্ধে বুধবার একটি মামলা করেছে বনবিভাগ, যাতে এক কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে। বুলু কাজীকে ওই মামলায় গ্রেপ্তারও দেখানো হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য বনবিভাগের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা গাজী মতিয়ার রহমান   বলেন, গত মঙ্গলবার মংলা বন্দরে মূল জাহাজ থেকে কয়লা নামিয়ে এমভি রাজে তোলার সময় পাশ থেকে এমভি সম্রাট নামের আরেকটি কার্গো ধাক্কা দেয়। এতে এমভি রাজে ফাটল দেখা দেয়।

“কার্গো লোড হয়ে যাওয়ায় ওই অবস্থায় মাস্টার জাহাজ নিয়ে জয়মনি এলাকায় একটি চরে যান এবং সেখানে সিমেন্ট দিয়ে ফাটল বন্ধ করার চেষ্টা করেন। এরপর জোয়ারের সময় ওই চর থেকে যশোরের পথে রওনা হলে এক পর্যায়ে তার জাহাজ ডুবে যায়। এ বিষয়গুলো আমরা প্রতিবেদনে লিখেছি।”

মতিয়ার রহমান জানান, যেখানে জাহাজ ডুবেছে, সেখানে তাঁবু দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, যাতে কয়লা সরে যতে না পারে।

“কয়লা বেরিয়ে গেলে নদী ও সুন্দরবনের জলজ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি হতে পারে বলে আমরা মনে করছি।”

তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো হল- সুন্দরবনের ভেতরে সংরক্ষিত এলাকার নৌপথে পণ্যবাহী ও বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ করা, সব জলযানের যথাযথ ফিটনেস নিশ্চিত করা, জলযান যাতে দক্ষ চালকের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করা এবং মংলা বন্দর সংলগ্ন সুন্দরবনের নদীগুলোতে এ ধরনের দূর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় আধুনিক সরঞ্জাম মজুদ রাখা।

মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিআইডব্লিউটিএ’র নিয়ম অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে ডুবে যাওয়া নৌযান মালিকপক্ষ নিজেদের উদ্যোগে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলে বন্দর বা নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সেটি উদ্ধারের চেষ্টা করে। এ আইন সংশোধন করে দূর্ঘটনা ঘটামাত্র দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরুর ব্যবস্থা করার কথাও সুপারিশে বলা হয়েছে।

জাহাজ উদ্ধারে অগ্রাধিকার

মতিয়ার রহমান জানান, ডুবে যাওয়ার তিনদিন পরও মালিকপক্ষ জাহাজটি তোলার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ বিষয়টি জানিয়ে প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক সুনীল কুমার কুণ্ডু   বলেন, “উদ্ধার কাজই এখন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে দ্রুত কীভাবে জাহাজ ও কয়লা অপসারণ করা যায়। কিন্তু এতো গভীর নদীতে উদ্ধার কাজ জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ হবে।”

ডিএফও সাঈদুল ইসলাম বলেন, “তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা কার্যক্রম নেব। সেই সঙ্গে মালিককে দ্রুত জাহাজ অপসারণ করতে বলা হবে।”

জাহাজ তুলতে বিলম্ব হলে কার্গো মালিকের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

পানি ও কয়লা পরীক্ষাগারে

কার্গোডুবিতে নদী ও বনের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব চিহ্নিত করতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি ও কয়লা পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাঈদুল জানান।

তিনি বলেন, “যেখানে জাহাজটি ডুবেছে সেখানকার পানি পরীক্ষার জন্যে পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ডুবন্ত অবস্থায় কয়লা ক্ষতিকর কিছু ছড়াচ্ছে কিনা কিংবা নেতিবাচক কিছু ঘটছে কিনা তাও পরীক্ষা করা হবে।”

সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌ যান চলাচল বন্ধে বন বিভাগের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবন রক্ষায় তারা পণ্যবাহী কার্গো ও তেলবাহী ট্যাংকারসহ বাণিজ্যিক নৌ চলাচল নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।

গত ৯ ডিসেম্বর শেলা নদীতে একটি তেলের ট্যাংকার ডুবে সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন দিয়ে নৌচলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিশ্বের বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনে বাণিজ্যিক নৌচলাচল পুরোপুরি বন্ধের জন্য সে সময় জাতিসংঘও আহ্বান জানিয়েছিল।

কিন্তু মংলা-ঘষিয়াখালি চ্যানেলের খনন কাজ শেষ না হওয়ায় ওই নৌপথে ২৭ দিন পর আবারও নৌযান চলাচল শুরু হয়।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় সে সময় সুন্দরবনে নৌচলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে চাইলেও মংলা বন্দর সচল রাখার যুক্তি দেখিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে তা ধোপে টেকেনি।

বন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে   বলেন, “আমরা তো নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, কিন্তু সরকার কি তা চায়? সুপারিশ তো করেই যাচ্ছি। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না।”

খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক সুনীল কুমার কুণ্ডু বলেন, “বন্দর ও বিআইডব্লিউটিএ যান চলাচলের বিষয়টি দেখভালের কথা রয়েছে। তারা তো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা সুপারিশ রেখেছি, এখানে একটা কনটিনজেন্ট টিম রাখতে বলেছি, যাতে দুর্ঘটনা হলে সঙ্গে সঙ্গে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে।”

সংরক্ষিত এলাকায় বাণিজ্যিক নৌ চলাচল বন্ধের পাশাপাশি পুরো কাজ তদারকিতে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.