শীর্ষ সংবাদসংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

সংখ্যালঘুদের হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠানো হবে!

10নড়াইল: পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশঙ্কায় রয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থকরা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হুমকি দিচ্ছে। আর তা দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। অভিযোগ রয়েছে, নৌকায় ভোট না দিলে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্বাচনের পর হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠাবে বলে হুমকি দিয়েছে।

সারা দেশের মতো জেলার কালিয়া পৌরসভার নির্বাচন আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। আর এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে চলছে নানা গুঞ্জন। চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে কি না তা নিয়ে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।

জেলার কালিয়া পৌরসভায় সরেজমিন ঘুরে এলাকাবাসী ও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পৌরসভার ছোট কালিয়া, বেন্দা, কুলসুর, রামনগর, শালবরাত, বড় কালিয়া, মির্জাপুর, কার্তিকপুর, গোবিন্দনগর গ্রামের ভোটারদের মধ্যে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। কারণ বিগত দুটি পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগে ও পরে কালিয়ার বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও সংখ্যালঘুরা নির্বাচনের পর তাদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের আশঙ্কা করছেন।

আওয়ামী লীগের ওয়াহিদুজ্জামান হিরা নৌকা ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ফকির মো. মুশফিকুর রহমান লিটন (চামচ) এবং বর্তমান মেয়র এমদাদুল হক টুলু (নারিকেল গাছ)  প্রতীকের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সেক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী ফকির মো. মুশফিকুর রহমান লিটন (চামচ) প্রতীক জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পৌরসভার বেন্দা গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, পাশের বেন্দারচর গ্রামে নড়াইল-১ আসনের সাংসদ কবিরুল হক মুক্তির বাড়ি। এ গ্রাম থেকেই মেয়র পদে চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন, বর্তমান মেয়র এমদাদুল হক টুলু (নারিকেল গাছ), ফকির মো. মুশফিকুর রহমান লিটন (চামচ), সোহেলী পারভিন নিরি (জগ) এবং মো. শেখ লায়েক হোসেন (মোবাইল ফোন)। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান হীরা নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।

বেন্দা গ্রামের মিনতি সরকার, নমিতা বিশ্বাস, শিপ্রা বিশ্বাস বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর সমর্থক ছাড়াও মেয়র পদের অন্য প্রার্থীর সমর্থকরা বলেছেন টেবিলের ওপর দেখিয়ে ভোট দিতে হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তিকে বিষয়টি জানিয়েছি। আমরা আতঙ্কের মধ্যে দিন-রাত পার করছি।’

শালবরাত গ্রামের দেবেন খাঁ, রামনগর গ্রামের উজ্জল সাহা বলেন, ‘মোটরসাইকেলে করে সন্ত্রাসীরা রাতে মহড়া দিচ্ছে।’ কালিয়া বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী বাপ্পী কুমার ঘোষ বলেন, ‘সাবেক পৌর মেয়র একরামুল হক টুকু দোকানে এসে নৌকায় ভোট দিতে বলেছে। না দিলে ভোটের পর দেখিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়।’

চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘২৪ ডিসেম্বর রাতে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা আমার বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। ইট-পাটকেল নিক্ষেপসহ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।’ সালেহা বেগম বলেন, ‘রাস্তার ওপর পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা এগিয়ে আসেনি। এ সময় তারা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।’

জেলা পূজা উদযাপন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক ও বেন্দা গ্রামের বাসিন্দা কোমল আঁখি বলেন, ‘বিভিন্ন প্রার্থীর লোকজন গ্রামের ভোটারদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের হুমকিধামকি দিয়ে চাপের মধ্যে রেখেছেন।’

মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান মেয়র এমদাদুল হক টুলু বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে আমি পৌরসভার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আমার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতেই পৌরবাসী আমাকে ভোট দিবে।’

স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মুশফিকুর রহমান লিটন নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা নৌকায় ভোট না দিলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ৩০ ডিসেম্বরের পর হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে পাঠানো হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন। বিষয়টি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে আমার সমর্থকদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’

বিএনপি প্রার্থী ওহিদুজ্জামান মিলু বলেন, ‘গণসংযোগকালে আমার সমর্থকদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে।’

অবশ্য নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামান হীরা এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘নির্বাচনে আমার অবস্থা ভালো দেখে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থীরা তাদের ভরাডুবির আশঙ্কায় নির্বাচনকে বানচাল করতে গুজব রটাচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর নজরদারি করছে।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও কালিয়া রিটার্নি কর্মকর্তা সেখ মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুজন মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ করে লিখিত আবেদন করেছেন। দুটি অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করে দেখা গেছে অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে যে অভিযোগ করেছেন তার তদন্ত কাজ চলছে।’

সংখ্যালঘুদের হুমকি বিষয়ে কোনো অভিযোগ জানা নেই জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ পৌরসভায় ৯টি কেন্দ্রের সবগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হলেও ৬ কেন্দ্রকে অধিক ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে ১৪ হাজার একশত ৪৪ জন ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ১২ জন পুরুষ এবং ৭ হাজার একশত ৩২ জন নারী।

কালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শোনিত গায়েন বলেন, ‘কালিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হুমকিধামকি দেয়া হচ্ছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.