মত-অমত

শেয়ার বাজারে পুঁজি হারায় মানুষ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

ক্যাপিটাল মার্কেট বা পুঁজিবাজার আমাদের দেশে শেয়ার বাজার নামে পরিচিত। পুঁজি বাজারে মানুষ বিনিয়োগ করে লাভের জন্য। কিন্তু আতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে এই বাজার এখন পুঁজি হারানোর বাজারে পরিণত হয়েছে।

আজ নতুন সপ্তাহের প্রথম দিন। সপ্তাহান্তে কী দাঁড়াবে পরিস্থিতি আমরা জানি না,কারণ বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে পুঁজি বাজার থেকে কোন ইতিবাচক খবর আসছে না। গত সপ্তাহে (২৬ সেপ্টেম্বর-০৩ অক্টোবর) দেশের শেয়ারবাজার থেকে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজি গায়েব হয়েছে। গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীরা ১৩ হাজার ৫৫০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বা ১.৯৭ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন। একই সঙ্গে কমেছে সব রকম সূচক ও টাকার অংকে লেনদেনের পরিমাণ। এছাড়া,কমেছে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর।

বাজারের লাগামহীন পতনে বেশি বিপদে পড়েছেন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে আসা লোকজন। কারণ ঋণের অর্থ আদায়ে অনেকের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার এখন একেবারেই মূল্যহীন। শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ের পর বর্তমান সরকার আর্থিক খাত সংস্কারের মনোযোগী হয়েছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে,বিগত সরকার কর্তৃক ধ্বংসপ্রায় ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরছে, সমস্যা পুরোপুরি কেটে না গেলেও অনেক ব্যাংকই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু পুঁজি বাজারের অবস্থা একেবারেই নাজুক।

শেয়ারবাজারের এই অবস্থাকে অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। যেভাবে দিনের পর দিন বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাচ্ছেন তাতে শেয়ারবাজারের ভবিষ্যত নিয়ে নানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারাও কোন শুভ বার্তা দিতে পারছেন না। বাজারে বলাবলি হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শুধু ধরপাকড় কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের লোকসান কাটানোর কোন পরিবেশ তৈরি করছে না।

দর কমার ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারছে না বাজার। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্থির জলাশয়ের মতো নয়, সেখানে ঢেউয়ের ওঠাপড়া চলবেই। পুঁজির নিয়মই হলো, মুনাফার লোভে নতুন বিনিয়োগ,নতুন কর্মকাণ্ডের পেছনে ধাওয়া করে বেড়ানো। কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের পুঁজিবাজার দীর্ঘ মন্দায় স্থির হয়ে আছে।

নতুন করে সংকটের শুরু ২৭টি কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে দেওয়ার কারণে। এতে বাজারের যে ক্ষতি হলো তার মাসুল বিনিয়োগকারীদের দিতে হচ্ছে। বন্ধ কোম্পানির শেয়ারে বিগত ৫/৭ বছর আটকে আছে অনেকের বিনিয়োগ। তাদের পুঁজির পরিণতি কী কেউ জানে না। কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে না পাঠিয়ে মালিকপক্ষকে শাস্তি দিলে বেশি কাজ হতো বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।

এখানেও হয়েছে এক প্রকার কারসাজি। বেশকিছু কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হচ্ছে-এমন খবর আগেই ছড়িয়ে পড়ে। আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা জারির আগেই বাজারে তার তীব্র প্রভাব পড়ে। মূল্য সংবেদনশীল এমন তথ্য এভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।

পুঁজিবাজারের অবস্থা অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই রুগ্ন। দিন যত যাচ্ছে বাজারের অসারতা বাড়ছে। আমাদের পুঁজিবাজারের খারাপ অবস্থা থেকে ভাল দিকে আনতে দুটি পদক্ষেপ বেশ দৃশ্যমান। এদের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে শেয়ার মূল্যের পরিবর্তনের উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া। কিন্তু এগুলো কোন কাজে আসছে না এখন। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মূল্য পরিবর্তনের সীমা ব্যবহারের কারণে বাজারে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শেয়ার মূল্যের সীমা নির্ধারণ ব্যবস্থার কারণে পুঁজিবাজারের অস্থিরতা কমার চেয়ে বরং তা আরও বেড়ে যায়। কারণ শেয়ারের দাম যখন কমতে থাকে সে অবস্থায় দাম পরিবর্তনের নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া হলে নিম্নসীমায় পৌঁছালে শেয়ার তার তারল্য হারায়। এই ভীতি বিনিয়োগকারীদের পেয়ে বসে। ফলে তারা ভীত হয়ে দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে দিতে থাকেন যার ফলে শেয়ারের দাম কমে নিম্নসীমায় অতি দ্রুত পৌঁছে যায়।

বিএসইসি-তে নতুন চেয়ারম্যান এসেছেন। ডিএসই নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পেয়েছে। তাদের ভাবা দরকার তারা কত যত দ্রুত মূল্য পরিবর্তনের সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবেন।

এই বাজারে জবাবদিহিতার বড় অভাব। বাজারের অনেক কোম্পানিই দিনের পর দিন ভালো মুনাফা করলেও বছর শেষে তারা ভালো লভ্যাংশ দেয় না। এতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ফলে বিনিয়োগকারীরা ভালো মুনাফা দেখে বিনিয়োগ করেও ঠকছেন।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অনেক দিন থেকেই আস্থার সংকটে ভুগছে। এই সংকটের মূল কারণ নীতিনির্ধারকদের এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দূরত্ব। বাজারে শেয়ার কারসাজি আছে। প্রশ্ন হলো দরবেশ নামক সালমান এফ রহমান এখন কারাগারে। এ অবস্থায় শেয়ার কারসাজি করছে কে? বা কারা? বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে পারাটাই হবে বিএসইসি’র কাজ।

লেখক: সাংবাদিক