Leadআন্তর্জাতিক

শেখ হাসিনাকে যে দুই নির্বাচনি বার্তা দিতে চায় ভারত

জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আগামী মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় দুটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে ভারত। তা হলো- বাংলাদেশে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে চীন ও ইসলামপন্থিদের বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে।

ভারতের নিরাপত্তা সংস্থার একটি সূত্র বলছে, শেখ হাসিনাকে এই দুটি বার্তা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্যের ইঙ্গিত দেয়।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে। এসব বৈঠক ভারত এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে হয়।

সূত্রটি আরও জানায়, অতীতে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় পার্থক্য ছিল (২০১৮ সালের মতো)। তবে এবার তারা ঐকমত্য বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জি-২০ সম্মেলনের জন্য দিল্লিতে থাকবেন, তখন তাকে বার্তা দুটি পৌঁছে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যদিও শেখ হাসিনার নজরে নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের ভোটের ছাপ আসন্ন নির্বাচনেও পড়তে পারে; যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিপরীতে নির্বাচন ঘিরে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন তুলেনি নয়াদিল্লি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই প্রথম শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ৯৬ শতাংশের বেশি আসন পায়।

সাধারণ ধারণা হলো, বাংলাদেশের নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে ভারত ততক্ষণ চিন্তা করবে না যতক্ষণ ফলাফল শেখ হাসিনার পক্ষে থাকে; যাকে নয়াদিল্লি সর্বদা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।

ঢাকায় কৌশলগত বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) এখনও ভারতের প্রিয় রয়ে গিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই…. তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতের উদ্বেগের সমাধান না করলে নয়াদিল্লি তাকে সমর্থন দেবে এমন সম্ভাবনা নেই।’

ইসলামি সন্ত্রাসীদের দমন থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দিয়ে ভারতের অনেক ইচ্ছা পূরণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের নৈকট্য নয়াদিল্লির উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতীয় ও মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের যেসব আলোচনা হয়েছে সেগুলো হলো-

বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোতে (সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে) চীন এবং ইসলামপন্থিদের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উভয় পক্ষই। পরিস্থিতির অবিলম্বে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে তারা। দিল্লি সফরে হাসিনাকে এই উদ্বেগ জানাতে ভারতীয় সংস্থা সম্মত হয়েছে।

উভয় পক্ষই দ্ব্যর্থহীনভাবে একমত হয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। শেখ হাসিনার সফরে ভারত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান দাবি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকায় বিষয়টি নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নেই।

শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি এবং ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে বলে উভয় পক্ষেরই ঐকমত্য রয়েছে। পাশাপাশি সরকারকে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে; যা সাধারণ বাংলাদেশিদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রাথমিক এজেন্ডা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় আনবে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ভারতীয় পক্ষ মার্কিন প্রতিনিধিদের যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে তাদের আপত্তির কথা জোরালোভাবে জানিয়েছে। তারা বলেছে, জামায়াত-ই-ইসলামি একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন। ভারত জামায়াতকে একটি উন্মত্ত মৌলবাদী সংগঠন বলে মনে করে।

বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত বলে নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।

একাধিক সূত্র জানায়, আসন্ন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির এমন মিল কেবল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের অতীতের পার্থক্যের কারণে নয়।

ঢাকার একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে। তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, তাদেরও দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে উৎসাহিত করবে। ক্ষমতাসীন দলের কোনও চক্রের প্রতি আনুগত্য নয়, জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করবে। অবশেষে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সূত্রটি আরও জানায়, এখন প্রশ্ন হলো শক্তিশালী নেতা শেখ হাসিনা যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে তিনি এসব পরামর্শ মানবেন কিনা।