মত-অমতসব সংবাদ

শুধু ব্যক্তির নয় সমাজ-সম্প্রদায়েরও দায় অাছে বৈকি!

ru-teacherসুস্মিতা চক্রবর্তী ।। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাবির শিক্ষকের মৃত্যু (অাত্মহত্যা!) নিয়ে ক’দিন ধরেই বেশ কিছু লেখা সামাজিকযোগাযোগ-মাধ্যমগুলোতে চোখে পড়ছে। অনেক জানা-অজানা তথ্য সে সব রচনা থেকে অামরা পাচ্ছি। কিন্তু যে প্রসঙ্গটি এখনও কারো-কোনো লেখায় পাই নি অথচ ঘটনা- পরবর্তী সময়ে রাবি-ক্যাম্পাসে হাজির হয়েই অামি শুনেছি তা হলো: অধ্যাপক অাকতার জাহান জলি ডিভোর্সের পরও একই বিভাগের তার সাবেকস্বামী-সহকর্মীর অত্যন্ত বাজে অাচরণের শিকার হতেন প্রকাশ্যে এবং তা বিভাগীয় অানুষ্ঠানিক-সভায় বসে!

ব্যক্তিগতভাবে অামি অধ্যাপক অাকতার জাহানের সাথে ঘনিষ্ট ছিলাম না। পরিচয় ছিলো অতটুকুই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার মৃত্যুর খবরটি শুনে সেদিন একরাশ বেদনা নিয়ে ক্যাম্পাসের জুবেরিভবনে উপস্থিত হই। সেখানে তখন গণযোগাযোগ বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে দেখা হয়। অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-সহকর্মীরাও তখন উপস্থিত হয়েছেন, হচ্ছিলেন। রাবির গণযোগাযোগ বিভাগের যে দু’তিনজন শিক্ষক-সহকর্মীর সাথে অামার খাণিক ঘনিষ্টতা রয়েছে, তারাই সেদিন দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে এ তথ্যটি অামায় জানিয়েছিলেন। অামার মনে হয়েছিলো, বিভাগীয় অন্য অনেক শিক্ষকরা বিষয়টি অবগত অাছেন। কিন্তু ওই বিভাগের কোনো শিক্ষকই বিষয়টি নিয়ে অদ্যাবধি মুখ খোলেননি!

akter-jahanউল্লেখ করার মত এ পর্যন্ত যতগুলো লেখা চোখে পড়েছে, সেগুলোর রচনাকারী প্রায় সকলেই নারী। বেশির ভাগই তার নিকটজন-বন্ধু। তারা তার মৃত্যু নিয়ে নানাভাবে কথা তুলেছেন, অনেক ব্যক্তিগত বেদনা-চাপের অজানা কথা সে সব লেখা থেকে বের হয়ে এসেছে। কেউ তার সুইসাইড-নোট-বিশ্লেষণ করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও তার উচিত-করণীয় ব্যর্থতাকে কেউ সমালোচনা-নির্দেশ করেছেন।

অামার অান্দাজ, অধ্যাপক অাকতার জাহান অানুষ্ঠানিকভাবেই বিবাহবিচ্ছেদ করেছিলেন। বিবাহবিচ্ছেদ মানে, অামরা সকলেই জানি, অানুষ্ঠানিক-অাইনী-প্রক্রিয়ায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কচ্ছেদ। এ ছেদ ঘটার পরও যদি তাকে বিগত সম্পর্ক-ব্যক্তির অশোভন অাচরণ সহ্য করতে হয় দিনের পর দিন তবে তো বলাই যায় যে, অাইনী-বিচ্ছেদে গিয়েও তিনি স্বস্তিতে বাস করতে পারেননি! একই কাঠামোগত মানসিক-নির্যাতন-চাপই কম-বেশি বইতে হয়েছে। বিচ্ছেদ-পরবর্তীতেও এ ধরনের নিয়মিত চাপ তাকে অারও বেশি হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। এসব ঘটনার যারা দ্রষ্টা, তাদেরও কী সামাজিক মানুষ হিসেবে, কর্মসূত্রীয় পরিচয়ে একজন সহকর্মীর এহেন পরিস্থিতিতে খাণিক দায় থাকে না! সে দায় তবে তারা কেন এড়ালেন?

অধ্যাপক অাকতার জাহান না হয় পুরুষতান্ত্রিক পরিবার-সম্পর্ক-বিচ্ছেদ ও বিচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ের এহেন চাপ মোকাবেলা করতে পারেন নাই কিন্তু তার শিক্ষিত-সহকর্মীরা কি এ বিষয়ে কোনো ভূমিকা নিয়েছেন সময় মতো? জানি না। কারও কোনো লেখায় চোখে পড়েনি এখনও যেখানে তিনি নিজে তার সুইসাইডনোটে ‘শারীরিক-মানসিক চাপ’-এর কথা জানিয়েছেন। অামার মনে হয়, বিষয়টি ধরে যথাযথ তদন্ত হওয়া জরুরি। তদন্তের স্বার্থে বিভাগীয় শিক্ষক-সহকর্মীদের মুখ খোলাও দরকারি খুব। তবে ঈশ্বর জানেন তারা সত্যটা বলবেন কিনা! অামার তো মনে হয়, পুলিশের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়েও এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। কিন্তু মৃতের পরিবার বা তার বিভাগের পক্ষ থেকে তা দাবি করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে। এখনও পর্যন্ত কেউ কি তা করেছেন কিনা অামার জানা নাই।

akhterঅধ্যাপক অাকতার জাহানের সুইসাইড-নোট-এর সামাজিক-অাদর্শিক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন তারই একজন প্রাক্তন সহকর্মী- অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন। সেখানে অাকতার জাহান ও তার সাবেক স্বামী সম্পর্কে বক্তিগত কিছু স্মৃতি-ঘটনাও এমনকি অাকতার জাহানের ‘পরকীয়-গুজব’ও তথ্যাকারে হাজির করেছেন তার লেখায়। জানা মতে, তিনি এখন ঢাবির অধ্যাপক। সেখানে বসে তিনি রাবির প্রাক্তন সহকর্মী আকতার জাহানের পরকীয়ার খবরও অবগত অাছেন! নিশ্চয়ই রাবির কেউ তাকে এসব গুজব-তথ্য দিয়েছেন। অামার কৌতূহল হয়, তিনি এমন তথ্য-গুজব জেনেছেন অার তা লেখাতে হাজিরও করেছেন অথচ বিভাগে যে অাকতার জাহান প্রকাশ্য-সভায় তার সাবেক স্বামীর অশোভন-ব্যবহারের শিকার হতেন সে সব নিয়ে কোনো তথ্যই কী তিনি পাননি!? কিংবা একজন নারীকে ঘায়েল করতে পরকীয়-এর মত প্রচলিত সহজসস্তা গুজব-তথ্যের মত অধ্যাপক অাকতার জাহানের সাবেক স্বামীর চরিত্র বিষয়ক কোনো গুজব-তথ্যও কি তিনি কখনো অবগত হননি! জানি না। তবে এ সব দেখে বেশ অবাক লাগে। উনার লেখার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও কোথাও মনে হয়েছে, সদ্যমৃত সহকর্মীর প্রতি তার খাণিক অসংবেদনশীল মনোভাবেরও যেন প্রকাশ ঘটেছে লেখাটিতে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অালোকে লেখক-অধ্যাপক কাবেরী গায়েন অধ্যাপক অাকতার জাহানের সাবেক স্বামী ও সহকর্মীর যে সুশোভন-ব্যবহার হাজির করলেন তার লেখায় তা সম্পূর্ণভাবে বিপরীত চিত্রই হাজির করে। অধ্যাপক অাকতার জাহান যেখানে নিজের সুইসাইডাল-নোটে তার সন্তানের প্রাণনাশের মত ভয়ঙ্কর অাশঙ্কার কথা নিজেই জানিয়ে গেছেন! সন্তান তার মায়ের সাথে দেখা করতে পারতেন না যেটা কোনোভাবেই কোনো অাইনে-সামাজিকতায় পড়ে না! অামি শুনেছি, সন্তান তার মায়ের কাছে তার বাবার এহেন অাচরণ জানিয়েছিলেন মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে। যদি তিনি তা মুছে ফেলে না থাকেন তবে হয়তোবা সে বার্তাটি উনার মোবাইলে এখনও সংরক্ষিত অাছে। এ সবের যথাযথ তদন্ত হওয়া বড্ড জরুরি জ্ঞান করি।

সবশেষে, একটুকরা স্মৃতি হাজির করে লেখাটি শেষ করবো: গত চার-পাঁচ মাস অাগে অামি ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরছিলাম। যাত্রা-বিরতিতে যখন নামলাম তখন অধ্যাপক অাকতার জাহানের সাথে অামার অাচমকা দেখা! তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন অামার দিকে। অামি তাকে জলি অাপা বলি। যাত্রাবিরতির ওইটুকু সময় অামরা একসাথে বসে খাণিকক্ষণ কথা বলি। সে দিন তাকে খুব বিমর্ষ লাগছিল যদিও তিনি হাসিমাখা মুখেই কথা বলছিলেন। এমনকি অামার খাবার-চা-পানির বিলটি পর্যন্ত অামাকে দিতে দেন নাই! অামি তখন একটু বিরক্তি নিয়েই তাকে বলেছিলাম: ‘জলি অাপা অাপনি তো অামাকে কোনো সুযোগই দিলেন না!’ অামি স্পষ্ট মনে করতে পারছি তার সেই ছোট্ট সংলাপটি: ‘অ্যাই, অামি বড় না!’ অামি সে প্রকাশভঙ্গীর কাছে আর কথা বাড়াতে পারিনি! অামার সেদিন সত্যি বলতে কি, উনাকে দেখে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিলো। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তার ব্যাকপেইনের সমস্যা অার এর চিকিৎসা নিচ্ছিলেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। যতদূর মনে পড়ে, জলি অাপাকে সেদিন বার বার স্পর্ধাভরে কেবল ভালো থাকার পরামর্শই বেশি করে দিয়েছিলাম। তারপর রাজশাহী ফিরে অামার বাসার খালাকেও জানিয়েছিলাম উনার কথা এভাবে যে, উনি অামার মতই ডিভোর্সী অার একা থাকেন কিন্তু উনাকে দেখে মনে হলো উনি ভালো নেই। এরপর যখন সম্প্রতি সময়ে উনার মৃত্যুর খবর অাচমকা পাই অার অামার এখানকার ঘরের সার্বক্ষণিকসঙ্গী সেই খালাকে জানাই, খালাও জলি-অাপার বিষয়ে ঠিক অাগের বারের কথাগুলো মনে করতে পারেন।

ব্যক্তিগত-জীবনে, অামি গত বছর পারস্পরিক সিদ্ধান্তে বিদ্যমান পরিবার-বিয়ে থেকে অানুষ্ঠানিক-অাইনীপ্রক্রিয়ায় বের হয়ে অাসি। তারও কিছু সময় অাগে উচ্চশিক্ষার জন্য অার সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে দূরে থাকতে রাজশাহী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। সুযোগ পেয়ে পড়তে যাই ভারতে। সে দিক থেকে, এক ডিভোর্সী নারীর প্রতি সঙ্গত-সংহতি থেকেই এক ঝলক দেখা হওয়া অধ্যাপক অাকতার জাহানকে বয়সে ছোটো হয়েও বার বার ভালো থাকার পরামর্শ দিয়েছিলাম সে দিনের যাত্রাবিরতির সাক্ষাতে।

অধ্যাপক অাকতার জাহান যে লড়াই করেননি তা তো নয়। গত ক’বছর ধরেই তিনি একা লড়াই করেছেন। হয়তোবা সে লড়াইয়ের শক্তি তিনি শেষে হারিয়ে ফেলেছিলেন শারীরিক-মানসিক চাপ অার সহ্য করতে না পেরে! তিনি অাজ চলে গেছেন অনন্তের পথে, সব কিছুকে ছাপিয়ে। যে অশান্তি-অাত্মা নিয়ে তাকে জীবনের মূল্য জেনেও স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথে হাঁটতে হলো, অনন্ত-যাত্রায় তার অাত্মা চিরশান্তি পাক– সে প্রার্থনাই করি। পাশাপাশি পুরো ঘটনাটিরই তদন্ত হওয়া অতি প্রয়োজন বোধ করি।

পরিশেষে বলি, অাত্মহত্যা কোনো সমাধান বা অাদর্শ পথ নয় তা জেনেও মানুষ নানা বিপর্যয়ে, নানা কারণে নিজের অাত্মাকে হত করতে উদ্যত হয়। নিজের জীবন সকলের কাছেই সবচেয়ে প্রিয়-মূল্যবান। তারপরও নারীপুরুষ জ্ঞানীঅজ্ঞানী নির্বিশেষে এ হেন কাজটি করে থাকেন। পৃথিবীতে অাত্মহত্যার ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। সমাজের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে অাত্মহত্যাকে সমর্থনের কোনো সুযোগই নাই। বরং এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে, নারী হিসেবে যে-কোনো নারীকে জীবনের যে-কোনো প্রতিকূলতাতেই লড়াকু দেখতে পছন্দ করি। তারপরও কোথাও কেউ কেউ একান্তে অাত্মাকে হত করে— নানান অার্থ-সামাজিক-মানসিক চাপ মোকাবেলা করতে না পেরে। এর দায় ব্যক্তির যেমন তেমন বিদ্যমান সমাজেরও কিন্তু কম নয়। ওম্ শান্তি!

susmitaসুস্মিতা চক্রবর্তী, লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।  

 

 

ঢাকা জার্নাল সেপ্টেম্বর, ১৪, ২০১৬।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.