Leadমত-অমতসব সংবাদ

শখ করে বৃটেনের নাগরিক হননি টিউলিপ

মাসকাওয়াথ আহসান || বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বৃটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক একটি টিভি ইন্টারভিউতে সাংবাদিকের সঙ্গে উত্তপ্ত কথোপকথনের মাঝে “তিনি বাংলাদেশী নন বৃটেনের এমপি” এমন মন্তব্য করায়; যেসব উগ্র জাতীয়তাবাদী বিরামহীনভাবে তার সমালোচনা করছেন; তারা টিউলিপের জীবন বাস্তবতা সম্পর্কে একবারও ভাবছেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার তাঁর ছিলো না।

যে কারণে তাঁকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। টিউলিপের জন্ম সে কারণেই লন্ডনে হয়। শখ করে বৃটেনের নাগরিক হননি টিউলিপ।

আর টিউলিপের বৃটেনে যে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠা; এখানে তার পারিবারিক পরিচয় কোন কাজে আসেনি। বরং নানারকম তিক্ত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত অন্য বৃটিশ এমপি’র ক্ষেত্রে শেকড়ের পরিচয় এমন তিক্ততার কারণ হয়নি।

এমনকী টিউলিপ লন্ডনের যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছেন; সেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ভোটার নেহাত কম বলেই নেতিবাচক ভোটের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। টিউলিপের খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় টিউলিপ কোথাও কোন বাড়তি সুবিধা নেননি। বরং এই আত্মীয়তার সম্পর্ক এই মুহূর্ত পর্যন্ত তাকে ভুগিয়ে চলেছে। কাঁকড়ার মত পা ধরে নীচে নামানোর মনোজগতটাই নদীধোয়া বাংলাদেশের একমাত্র মালিন্যের দিক; আর সবই ঔদার্য্যের; সৌন্দর্য্যের আর উষ্ণতার।

তাই অতিনেতিবাচকতা থেকে বাংলাদেশী সমাজের বেরিয়ে আসা জরুরী। আর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি; সেটি জনসমাজের আচরণে খুবই গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। নিকৃষ্ট আচরণের জনপদ দক্ষিণ এশিয়াতেও ভারত-পাকিস্তানের নাগরিক বা বংশোদ্ভুত অন্যদেশের নাগরিকেরা তাদের নিজ নিজ দেশের জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। এইক্ষেত্রে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে জাতির জনককে অশ্রদ্ধা জানানোর অপসংস্কৃতি চলমান। এই আদিম প্রবণতাটি বন্ধ করা গেলে রাজনীতি ব্যবসায়ীদের “বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধা জানিয়ে” ব্যবসা করার দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়া যাবে চিরতরে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিক হিসেবে যে গুণগুলো ছিলো তা থাকলে পৃথিবীর যে কোন দেশে রাজনীতিক হিসেবে সফল হওয়া সম্ভব; তার প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর নাতনি টিউলিপ; যে টিউলিপ পারিবারিক রাজনীতির দোকানদারির প্রচলিত স্রোতের বাইরের মানুষ। একটি টেলিভিশন ইন্টারভিউ যেখানে সাংবাদিকতা নৈতিকতা ভেঙ্গে একজন সাংবাদিক একজন একটিভিস্টের মত টিউলিপকে বিব্রত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন; তার প্রধানমন্ত্রী খালাকে একটি ফোন করে বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে দেয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন, সেখানে টিউলিপ নিজের রাজনীতির কর্মসীমা বৃটেন এটা বোঝাতে বলেছেন, তিনি বৃটিশ নাগরিক; বাংলাদেশী নন।

কারণ বাংলাদেশের অসংখ্য নিখোঁজ মানুষকে খুঁজতে গেলে; টিউলিপকে সারাদিন কেবল প্রধানমন্ত্রী খালাকেই ফোন করতে হবে।
বৃটেনের রাজনীতি তথা জনসেবার সময়ই তিনি পাবেন না।

কাজেই একটি বক্তব্যের সমগ্র বার্তাকে বুঝতে চেষ্টা না করে; এই যে অংশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া; এই প্রচলিত সামাজিক বদ-অভ্যাসটি খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে মনে হয়।

মাসকাওয়াথ আহসান
মাসকাওয়াথ আহসান

বাংলাদেশ আয়তনে ক্ষুদ্র; এখানে খুব অল্প জায়গায় আঁটোসাঁটো করে অনেক মানুষের বসবাস। দেশে বসবাসকারী মানুষের একটু শ্বাস নেবার জায়গা করে দিতে; দেশের সীমিত সম্পদে ভাগ না বসাতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ছেলে-মেয়েরা অন্যদেশে বসবাস করছে; সেসব দেশের নাগরিক হচ্ছে; রাজনীতিসহ নানাপেশায় কাজ করছে। তাদের মূল দায়িত্ব সেসব দেশের দায়িত্ব পালন; সে দায়িত্ব পালনের পর তারা নিজের ফেলে আসা বাংলাদেশের জন্য কোন বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে পারলে ভালো। নাপারলেও ক্ষতি নেই। বাংলাদেশ মায়ের মত স্নেহের আঁচল বিছিয়ে রাখে; মায়ের তো সন্তানের কাছে কিছুই চাওয়ার থাকে না; সন্তান যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক; এটাই তাঁর একমাত্র প্রত্যাশা।

ঢাকা জার্নাল, নভেম্বর ৩০ , ২০১৭।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.