রাজনীতিস্পটলাইট

রাষ্ট্রপতির অপসারণর নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রাজনৈতিক দলগুলো

ঢাকা জার্নাল ডেস্ক:

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগপত্র’ বিষয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন গণমাধ্যমে কথা বলার পর তাকে অপসারণের ইস্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা।

পাশাপাশি ডালপালা মেলছে বিভিন্ন গুঞ্জনের। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। সবমিলিয়ে এ ইস্যুতে দেশ জুড়ে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠনের আন্দোলনকারীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি শপথভঙ্গ করেছেন, তার আর এ পদে থাকার অধিকার নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি নিজ থেকে পদত্যাগ করবেন নাকি সরকার তাকে অপসারণের উদ্যোগ নেবে- তা নিয়ে অলোচনা চলছে সর্বত্র। রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্য ‘দৃশ্যত সতর্ক’ পর্যবেক্ষণ করছে পরিস্থিতির, নিয়েছে কিছুটা কৌশলী অবস্থানও। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ ইস্যু যখন দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে তখন বুধবার (২৩ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল। দলটি বলছে, দেশে এই মুহূর্তে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা তৈরি হোক- তা চায় না তারা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদে থাকা বা না থাকার বিষয়টি এ মুহূর্তে দেশের জন্য আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন তিনি। আর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নবগঠিত কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন রাজনৈতিক নেতারা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে রাষ্ট্রপতি থাকবেন আর যদি না চান তাহলে থাকবেন না।

এমন পরিস্থিতিতে এদিন সন্ধ্যায় বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংগঠন দুটির আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলন থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।

তবে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বুধবার পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনের সড়কে বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিক্ষোভ হয়েছে। এতে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। আন্দোলনকারীদের ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়ও দেখা যায় বঙ্গভবন এলাকায়। বঙ্গভবনের ফটকের সামনে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন ও বিজিবির সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে।

তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না? এ প্রশ্নটি এই মুহূর্তে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। এটা একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে জানিয়ে তিনি সবাইকে শান্ত থাকারও আহ্বান জানান।

রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা সবাই জানি, একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সেই সময় বিদ্যমান সংবিধান ও রাষ্ট্রপতিকে রেখেই সরকার গঠন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের যদি মনে হয়, এই সেট-আপে (কাঠামো) সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে অথবা জনগণ এই সেট-আপে অসন্তুষ্ট, তাহলে এই সেট-আপ নিয়ে আমরা ভাবব।

রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সেই আলোচনা ইতিমধ্যে চলছে। আলোচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করছি।

রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার রাষ্ট্রের ‘স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা’ তিনটি বিষয় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান তথ্য উপদেষ্টা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র সংক্রান্ত ইস্যু ঘিরে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চাচ্ছেন অনেকেই। গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে রাতভর এ নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে।

তথ্য উপদেষ্টা সেই বিক্ষোভ কর্মসূচির বিষয়ে বলেন, ‘বঙ্গভবন বা অন্য কোথাও বিক্ষোভের প্রয়োজন নেই। জনগণের মেসেজ আমরা পেয়েছি।’

রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, সরকার আলোচনা করছে। এর মাধ্যমে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে। যা রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে যাবে।

বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের পক্ষে বিএনপির দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। বর্তমান ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে ৭২-এর সংবিধান বাতিল ও রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। নিচের কোন বক্তব্যকে আমরা বিএনপির বক্তব্য হিসেবে ধরব?

তিনি ফেস দ্য পিপল নিউজের একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেছেন। যেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে বিদায় না করলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায় না বিএনপি।

রাষ্ট্রপতির বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে রাষ্ট্রপতি থাকবেন, আর যদি না চান তাহলে থাকবেন না। এটা নির্ধারণ করবেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অতি উৎসাহী হয়ে কেউ দেশকে অস্থির করবেন না।

নুর বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাতে ৪০ জন বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ কী করল? কেন তাদের প্রতিহত করা হলো না? একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে এর দায়িত্ব কে নিত? সেখানে গণঅধিকার পরিষদের একটি ব্যানারে বিক্ষোভ করা হয়। তারা গণঅধিকার পরিষদের কেউ নয়।

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হলে- তা সাংবাদিকদের জানানো হবে। গতকাল দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর।

এ সময় সাংবাদিকরা জানতে চান, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবার বিক্ষোভ-আলটিমেটাম এসেছে, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী? জবাবে প্রেস সচিব বলেন, আমাদের অবস্থান আপনারা দেখেছেন, আমরা বলেছি তারা (বিক্ষোভকারীরা) যেন বঙ্গভবনের পাশ থেকে সরে যান। বঙ্গভবনের আশপাশে নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়েছে।

বঙ্গবভনের সামনে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের সামনে ও চারপাশে কাঁটাতারের ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। যাতে করে কোনো আন্দোলনকারী ভেতরে ঢুকতে না পারে। বঙ্গভবনের ফটকের সামনে বিপুলসংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। এ ছাড়া সাদা পোশাকের পুলিশসহ গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। সেখানে যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটতে পারে।