সংবাদ শিরোনামসব সংবাদ

রাব্বীর পর এবার শিকার বিকাশ

06বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে পুলিশি নির্যাতনের জের না কাটতেই ঘটল আরেক নির্যাতনের ঘটনা। এবার সাদা পোশাকধারী পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) এক কর্মকর্তা। ডিএসসিসির পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে (৪৫) বেধড়ক পিটিয়েছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। গতকাল শুক্রবার ভোর রাতে মীরহাজিরবাগ এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। বিকাশ চন্দ্র দাস গুরুতর আহত অবস্থায় রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পাওয়ায় ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না তিনি। এ অবস্থায় বিকাশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘পুলিশ আমাকে অমানুষিকভাবে পিটিয়েছে। লাঠি ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিকাশের স্ত্রী স্বরসতী দাস ও বিকাশের বড় ভাই দীপক কুমার দাস বলেন, বিকাশ চন্দ্র ডিএসসিসির ৫ নম্বর জোনের (ওয়ার্ড-৪৮ ও ৫০) পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক (সিআই) হিসেবে কর্মরত। প্রতিদিনের মতো ভোররাতে দায়িত্ব পালনের জন্য দয়াগঞ্জের জেলেপাড়া ১০ নম্বর বাসা থেকে মোটরসাইকেলযোগে বের হন তিনি। মীরহাজিরবাগ খালের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রাবাড়ী থানার একদল সাদা পোশাকধারী পুলিশ তাঁকে মোটরসাইকেল থামানোর সংকেত দেয়। বিকাশ তাঁর পরিচয় দেওয়ার পরও এসআই আরশাদ হোসেন আকাশ ও এসআই মনোজ তাঁকে মারধর করে। তাঁকে ছিনতাইকারী ভেবে অচেতন অবস্থায় তাদের পুলিশ ভ্যানে তোলে। এ খবর পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তারা পুলিশ ভ্যানটি ঘেরাও করে। এ সময় পুলিশ তড়িঘড়ি করে তাঁকে ভ্যান থেকে নামিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। পরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বিকাশকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়।

দীপক কুমার দাস অভিযোগ করেন, এসআই আরশাদ হোসেন আকাশ মোটরসাইকেল থামানো মাত্রই কোনো কারণ ছাড়াই বিকাশের ঘাড়ে আঘাত করেন। এ সময় বিকাশ তাঁর পরিচয় দিলেই গলা চেপে ধরে বলেন, ‘তোর কোন বাপ আছে, নিয়ে আয়।’ এ সময় যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মনোজ ও এসআই রাসেল উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের ডিসি সৈয়দ নুরুল ইসলাম   বলেন, ‘ওয়ারী এলাকায় ছিনতাই ঠেকাতে ছিনতাই প্রতিরোধ টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের অর্জনও বেশ ভালো। বিকাশের ঘটনাটি স্রেফ ভুল বোঝাবুঝি। এ ঘটনায় এডিসি মোহাম্মদ মইনুল হাসান ও এসি (প্রশাসন) কামরুল হাসানকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে কোনো ধরনের গাফিলতি পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ধাওয়া করে হামলা এবং সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে ডিসি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বিকাশ দৌড় দেওয়ার কারণে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা মনে করেছে, তিনি ছিনতাইকারী। তাই তাঁরা উনাকে ধরে ফেলেন। আসলে এটি একটি ভুল বুঝাবুঝি। আর সত্যিকারের ছিনতাইকারী হলে তাঁর কাছে তো অস্ত্র থাকতে পারত। তা দিয়ে পুলিশ সদস্যদের আঘাতও করতে পারতেন। পরিচয় জানার পর তাঁকে আর মারা হয়নি।’ তবে ঘটনাস্থলে সাদা পোশাকে দুজন এবং ইউনিফর্মে দুজন করে চারজন পুলিশ সদস্য ছিলেন বলে দাবি করেছেন তিনি।

এদিকে একের পর এক ঘটনার পরও দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকারকর্মী, আহত বিকাশের স্বজন ও সহকর্মীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কড়া নির্দেশনা থাকার পরও বিভিন্ন থানার পুলিশ সাদা পোশাকে (সিভিল টিম) দায়িত্ব পালন করছেন। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশকে মারমুখো না হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। এরই মধ্যে গতকালের ঘটনা ঘটেছে মূলত পুলিশেরই দায়িত্বহীনতার কারণে।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বিকাশের বড় ভাই দীপক কুমার দাস জানান, প্রথমে বিকাশকে ঢাকা মেডিক্যালের ২০১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বেডে চিকিৎসা চলে। এরপর তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

পুলিশের বক্তব্যের ব্যাপারে বিকাশের ভাই দীপক দাস ও ভগ্নিপতি চন্দন দাস বলেন, সাদা পোশাকে থাকার কারণে বিকাশ পুলিশকেই ছিনতাইকারী ভেবেছেন। এ কারণে তিনি তাঁদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইছিলেন। তবে ধরার পর পরিচয় দিলেও তাঁকে নির্যাতন করা হয় বলে দাবি করেন বিকাশের স্বজনরা।

গতকাল দুপুরে আহত বিকাশকে ঢাকা মেডিক্যালে দেখতে এসে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শঙ্কর কর বলেন, ‘পরিচয় জানা গেলে এমনটি হতো না। সাদা পোশাকধারী চারজন পুলিশ বিকাশকে থামার সংকেত দেন। বিকাশ পুলিশকে ছিনতাইকারী ভেবে মোটরসাইকেল রেখে দৌড় দেন। আর পুলিশও বিকাশকে ছিনতাইকারী ভেবে মারধর করেন। ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত।’

হাসপাতালে গিয়ে মানবাধিকারকর্মী আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘আমি নিজে গিয়ে দেখলাম বিকাশের রক্তাক্ত শরীর। জনগণের জানমাল হেফাজত করার কথা পুলিশ বাহিনীর। কিন্তু পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এখন ভাবার সময় এসেছে এই বাহিনীকে তাদের নিয়মনীতির মধ্যে আনার। এ বাহিনীর যে দুর্বৃত্তরা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের কী করে আইনের আওতায় আনা যায়, সে বিষয়টিও ভাবতে হবে।’

এদিকে ঘটনার পর সিটি করপোরেশনের ওই এলাকায় কর্মরত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে পুলিশ ও স্থানীয় কাউন্সিলর কর্মীদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো. বিলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি পুলিশ আমাদের কর্মকর্তাকে প্রহার করেছে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সুস্থ হলে তাঁর কাছ থেকে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বিকে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ বানানোর ভয় দেখিয়ে এবং নির্যাতন করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ সিকদার। ওই ঘটনার পর এসআই মাসুদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কার্যত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পুলিশ সদরের তদন্ত কমিটি : বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে পুলিশের নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। কমিটির প্রধান করা হয়েছে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদকে।

গত রাতে পুলিশ সদরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) নজরুল ইসলাম এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, দুটি ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি খুব শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

 

 

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.