সব সংবাদ

যা অনুশীলন করি না, তা উপদেশ দেওয়া যায় না

বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে ধর্মকে ভোট ব্যবসার ‘অনুভূতি বাক্স’ হিসেবে রাজনীতি ব্যবসায় লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোন উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ-প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতের বর্ণহীন নির্দলীয় মানুষেরা হিন্দুত্ববাদি মোদির মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন জারির যে প্রতিবাদ করছে; জীবনবাজি রেখে; তা দেখে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। ভারতের বিশাল হিন্দু জনগোষ্ঠী মুসলমানদের বিপদে পথে নেমে প্রতিদিনই প্রাণ দিচ্ছেন। তাদের এই যে অন্যধর্মের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ; এটা দেখে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে শিখতে হবে।

ইসলাম ধর্মের প্রাণ পুরুষ মুহম্মদের জীবনের একটা ঘটনার কথা বেশির ভাগ মানুষই জানেন। তবু আবার বলছি; প্রসঙ্গক্রমে। এক মা তার শিশুকে নবীজীর কাছে এনে অভিযোগ করেন, আমার বাচ্চাটা সারাক্ষণ মিষ্টি খায়; আপনি ওকে নিষেধ করুন অনুগ্রহ করে। নবীজী একটু ভেবে বাচ্চাটিকে নিয়ে কদিন পরে আসার অনুরোধ করেন তার মাকে। নবীজী নিজেই মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন। কটাদিন মিষ্টি কম খাবার অনুশীলন করেন। এরপর শিশুটিকে নিয়ে তার মা এলে, নবীজী শিশুটিকে বুঝিয়ে বলেন, পরিমিত মিষ্টি খেতে। যে কোন কিছুতেই পরিমিতি জরুরী তা বুঝিয়ে বললেন।

তার মানে আমি নিজে যে অনুশীলন করি না; সে বিষয়ে কাউকে হিতোপদেশ দেবার যোগ্য নই। এই যে ভারত রাষ্ট্রটির কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক নাগরিক আইন বানিয়েছে; আগের অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক আইনটি সংশোধন করে; সেই কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে দুটি হিতোপদেশ দেবার যোগ্য আমি কীনা তা ভেবে দেখতে হবে। ভাবতে হবে, বাংলাদেশের মত নব্বুই শতাংশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে ঘটা করে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণার কোন যৌক্তিকতা আছে কীনা। এই ঘোষণা বাংলাদেশে বসবাসকারী বাকি ১০ শতাংশ অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক কীনা! নব্বুই শতাংশ বনাম দশ শতাংশের বিশাল সংখ্যা ব্যবধানই বলে দেয়, রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা বৈষম্যমূলক।

ধর্ম মানুষের খুব ব্যক্তিগত আশ্রয়। সৃষ্টিকর্তার ওপর নির্ভরতার সুন্দর সম্পর্কটিকে রাষ্ট্রের বিভাজন ব্যবসার অপবিত্র গলিঘুঁচিতে প্রবেশ করানো; ধর্মের মাহাত্ম্যকে পথে নামিয়ে দেবার আয়োজন; এ যেন রাষ্ট্রের জুয়া খেলার টেবিলে নিজের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সৃষ্টিকর্তাকে বাজি রেখে লুন্ঠনের কারবার চালিয়ে যাওয়া। যারা সত্যিকার অর্থে নিজের পবিত্র ধর্ম আর সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসেন, জুয়া খেলায় প্রিয়জনকে বন্ধক রাখার এই স্বার্থপর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার কথা নয় তাদের।

বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে ধর্মকে ভোট ব্যবসার ‘অনুভূতি বাক্স’ হিসেবে রাজনীতি ব্যবসায় লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কোন উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ-প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতের বর্ণহীন নির্দলীয় মানুষেরা হিন্দুত্ববাদি মোদির মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন জারির যে প্রতিবাদ করছে; জীবনবাজি রেখে; তা দেখে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। ভারতের বিশাল হিন্দু জনগোষ্ঠী মুসলমানদের বিপদে পথে নেমে প্রতিদিনই প্রাণ দিচ্ছেন। তাদের এই যে অন্যধর্মের মানুষের জন্য আত্মত্যাগ; এটা দেখে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে শিখতে হবে।

ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদের উত্থানের এই অন্ধকার সময়টি অতিক্রম করে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নবজাগরণ সূচিত হবে; এটা কষ্টকল্পনা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে দেশে দেশে অসভ্যতার বিরুদ্ধে সভ্যতার এই লড়াই হয়েছে। লড়াইয়ে সভ্যতা জিতেছে। আজকের পৃথিবীতে অপেক্ষাকৃত সভ্য দেশ বলে বিবেচিত যারা; তাদের সবার জীবনে আজকের দক্ষিণ এশিয়ার মতো এমন অন্ধকার সময়টি এসেছিলো।

ধর্মীয় বিভাজনের নিকৃষ্ট কুরুক্ষেত্র দক্ষিণ এশিয়া। সে কারণে আজ যে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর নিপীড়নে কষ্ট পাচ্ছে; কাল সে সংখ্যাগুরু হওয়া মাত্র সংখ্যালঘুর ওপর চড়াও হচ্ছে। এমনি এক নিপীড়নের নেশায় দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কট্টর-নরভোজি হয়ে উঠেছে। এই ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান ও বাংলাদেশে অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা নিঃগৃহীত হয়েছে; তাদের হত্যা-লুন্ঠন-উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। আবার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছে। মৃত এবং জীবন্মৃত জীবনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশেই যেন ধর্ম-পরিচয়ের কারণে কেউ মৃত কিংবা জীবন্মৃত না হয়; সেই সভ্যতা নির্মাণের লড়াই ভারতের চলমান লড়াইটি।

ধর্মীয় বৈষম্যের এই কুরুক্ষেত্রে আসল যে সংকট; সম্পদ বৈষম্য; সেটি বার বার চাপা পড়ে যায়। ফলে পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষের বসবাস এই দক্ষিণ এশিয়ায়।

এখন এই সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর ধারণা কতটা আইরনিক্যাল তা বোঝা যায়, যখন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে সম্পদ ও ক্ষমতা কতিপয়ের হাতের মুঠোয় থাকতে দেখা যায়। সংখ্যালঘু সম্পদ ও ক্ষমতাশালী লোকেরা কী দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন-শোষণ-নিপীড়ন করছে দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষকে। ধর্মের ভিত্তিতে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখা কৃত্রিম বিভাজনটি সরিয়ে ফেললেই এই যে ধনী-গরীবের বিভাজনের যে নির্মম বাস্তবতা সেটি স্পষ্ট হবে। সেটিকে আড়াল করতেই ধর্মকে বিভাজনের রাজনীতিতে ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় এক শতক ধরে হিন্দু-মুসলমান হাডুডু খেলাটি জারি রাখা হয়েছে।